খেলাপি ঋণ কমছেই না। বরং উদ্বেগজনক হারে বিপৎসংকেত দিয়েই যাচ্ছে। মার্চ পর্যন্ত তথ্য ধরলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার কোটি টাকা, যা জুন প্রান্তিকে নির্ঘাত লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।
কিন্তু ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়ে পিছু নিয়েছে বিপুল অঙ্কের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ। বর্তমানে এমন ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে থাকা এসব ঋণগ্রহীতা যদি সময়মতো কিস্তি পরিশোধ না করেন, তাহলে তা খেলাপি ঋণের হিসাবে যুক্ত হয়ে যাবে। সেটি হলে ব্যাংকিং সেক্টরসহ পুরো অর্থনীতির জন্য বড় দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। এমনটিই বলছেন বিশ্লেষকরা।
ব্যাংকিং খাতে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টে (এসএমএ) ঋণের অঙ্ক বেড়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। এ কারণে এই ঋণের অঙ্ক প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়া শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণও লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্টে উঠে এসেছে এমন উদ্বেগজনক তথ্য।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিআইবিএম-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম সোমবার বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ের খুব বেশি সম্ভাবনা দেখছি না। কারণ খেলাপির বেশির ভাগ টাকাই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ধরতে চাইলে এসব ঋণখেলাপি বিদেশে পালিয়ে যান। কারণ তারা সেখানে বাড়ি-গাড়ি. অট্টালিকা গড়েছেন। এসব প্রভাবশালী ঋণখেলাপি থেকে প্রচলিত আইনে টাকা আদায় করা যাবে না। তাদের ধরতে হলে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে গঠিত ট্রাইব্যুনালের আওতায় বিচার করতে হবে। তাদের সম্পদ ক্রোক করতে হবে। কোনো ধরনের আপিলের সুযোগ দেওয়া যাবে না।’
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখন হয়তো বা বিনিয়োগ নেই। ওদিকে ব্যাংকে টাকাও আছে। তাই আসল সংকটটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বিনিয়োগ পরিবেশ ফিরে এলে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে খেলাপি ঋণ। দেখা দেবে মহাসংকট।’
ব্যাংক খাতের নিয়মানুযায়ী কোনো ঋণের ৮টি কিস্তি অনাদায়ি থাকলে সেই ঋণকে এসএমএ হিসাবে গণ্য করা হয়। আর যে ঋণের কিস্তি নির্ধারিত তারিখে পরিশোধ করা হয় না, সেই ঋণকে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বলা হয়। মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঋণ ৯ মাস থাকার সুযোগ রয়েছে। এ সময়সীমা অতিক্রম করলেই খেলাপি হবে। নানা ধাপে উল্লিখিত দেড় লাখ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে যাওয়ার বিষয়টি ঋণখেলাপির আগের ধাপ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টে (এসএমএ) ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ১০৪ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগে অর্থাৎ গত ডিসেম্বরে ছিল ৪৪ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে এসএমএ মানের ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। আর ২০২০ সালের মার্চে ছিল ৪৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকার এসএমএ ঋণ। বছরের ব্যবধানে এসএমএ ঋণ বেড়েছে ২৭২ কোটি টাকা।
জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন সোমবার বলেন, ‘খেলাপি হওয়ার আগের ধাপের ঋণগুলোর গন্তব্য সাধারণত দুই ধরনের। তবে বড় একটি অংশ খেলাপির দিকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালের কিছু ঘটনা ও পরিসংখ্যান এমনই ইঙ্গিত বহন করে। তাই যদি হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের এখনই বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন বা ঋণ তদারকির বিষয়টি কার্যকরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।’
এদিকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে ৯৮ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৮৫ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর তিন মাসের হিসাবে এই অঙ্ক আরও বেশি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শিল্পে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র তিন মাসে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ২৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে শিল্প খাতে ৯০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিতরণ কমেছে ৬৯৫ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৭৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা বা ৮০ দশমিক ২৯ শতাংশ বিতরণ হয়েছে বড় শিল্পে। মাঝারি শিল্পে বিতরণ হয়েছে ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশ, আর ক্ষুদ্র শিল্পে বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত মার্চ পর্যন্ত বিতরণ করা এসব ঋণের মধ্যে মেয়াদি ঋণের অঙ্ক ছিল ১৭ হাজার ৩৭৯ কোটি এবং আর চলতি মূলধন খাতে বিতরণ করা হয়েছে ৭৩ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, শিল্পঋণে মার্চ পর্যন্ত বকেয়া ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিল্পের আকার অনুযায়ী বৃহৎ শিল্প, মাঝারি শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পে বকেয়ার হার যথাক্রমে ৭৭ দশমিক ৬৯, ১৪ দশমিক ২৭ এবং ৮ দশমিক ০৪। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্পঋণে বকেয়ার অঙ্ক ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। খাতভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে যথাক্রমে ৫ দশমিক ৯৮, ২৭ দশমিক ০৭ ও ১ দশমিক ১১ শতাংশ বকেয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ শেষে মেয়াদি শিল্পঋণের বকেয়া স্থিতি ছিল ২ লাখ ৬৬ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা।
এক বছর পর অর্থাৎ চলতি বছরের মার্চে তা ১২ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়ে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৪৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে চলতি মূলধন ঋণে বকেয়া ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়ে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। এর প্রায় অর্ধেক শিল্প খাতের। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি বেড়েছে ৬ হাজার ৮০২ কোটি টাকা।
তবে চলতি বছরের মার্চ শেষে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় খেলাপি বেড়েছে ২ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। একজন গ্রাহকের মেয়াদি ঋণের ৬টি মাসিক কিস্তি অপরিশোধিত থাকার পর আরও তিন মাস অনাদায়ি থাকলে সেটা ‘নিুমান’ খেলাপি হিসাবে বিবেচিত হয়। পরিশোধের প্রথম ৬ মাস পার হওয়ার পর ৩ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত তা নিুমান ধরা হবে। আর ব্যাংক কোম্পানি আইনে যেহেতু ৬ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ খেলাপি বিবেচিত হয়, ফলে প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের একটি ঋণ ১২ থেকে ১৫ মাস পর্যন্ত নিুমান বিবেচিত হয়। তবে মেয়াদি ঋণ বাদে অন্যসব ঋণ ৩ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে তা ‘নিুমান’ খেলাপি।
আর ৯ থেকে ১২ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা ‘সন্দেহজনক’ মানের খেলাপি। একই সঙ্গে ১২ মাসের বেশি অনাদায়ি থাকলে ‘ক্ষতিজনক’ বা মন্দ মানের খেলাপি বিবেচনা করা হয়।
সূত্র: যুগান্তর