এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার সিন্ডিকেট ঋণের নামে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা লোপাট করেছে।
এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে চক্রটি ওই অর্থ আত্মসাৎ করে।
সোম, মঙ্গল ও বুধবার এ ৩ দিন ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিষ্ঠানটির (এফএএস) পরিচালনা পর্ষদ ও এমডি দোষ স্বীকার করেছেন। এ সময় তারা ‘ঋণ অনুমোদনে অনিয়মের কথাও স্বীকার করেন। এজন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেন।’
ঋণের টাকা পুনরুদ্ধারের জন্য কিছুদিন সময়ও প্রার্থনা করেন তারা। স্বীকারোক্তিতে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহরিয়ারের এক স্বাক্ষরেই ৭০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়।
আর অস্তিত্বহীন কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়া হবে তা আগেই জানিয়ে দিতেন পিকে হালদার। যদিও তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো দায়িত্বেই ছিলেন না। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় তাদের ওই স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা হয়েছে। দুদক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বাধীন একটি টিম পিকে সিন্ডিকেটের দুর্নীতির অভিযোগগুলো অনুসন্ধান করছেন। আর অনুসন্ধান কাজের তদারককারী কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত আছেন দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ।
অর্থ লোপাটের সত্যতা পাওয়ায় এ ব্যাপারে শিগগিরই কমিশনে মামলার সুপারিশ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
যেভাবে অর্থ লোপাট : এফএএস ফাইন্যান্সের একাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদকের অনুসন্ধান টিম জালিয়াতি প্রক্রিয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। একই সঙ্গে ফাঁস ফাইন্যান্স থেকে পিকে হালদার চক্র ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের প্রমাণও পেয়েছে।
২০১৪ সালের শেষের দিকে পিকে হালদার সিন্ডিকেট শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। চক্রটি কৌশলে পুরাতন কর্মচারীদের ছাঁটাই করে পছন্দের লোক নিয়োগ দেয়। এদের একজন মো. রাসেল শাহরিয়ার। তাকে এমডি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তিনি পিকে হালদারের পূর্বপরিচিত। মূলত উজ্জ্বল কুমার নন্দী তার পছন্দমতো পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক নিয়োগ দেন। লোক দেখানো বোর্ড মিটিং হতো এবং বোর্ডে এমডিকে দ্রুত ঋণের ব্যবস্থার কথা বলা হতো।
আর রাসেল শাহরিয়ার প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব যাচাই ছাড়া কোনো মর্টগেজ না নিয়েই তার একক স্বাক্ষরে ক্রেডিট মেমো বোর্ডে উপস্থাপন করে ঋণ অনুমোদন নিতেন। ঋণের অর্থ পিকে সিন্ডিকেটের হিসাবে পাঠিয়ে দিতেন।
টেকওভার করা ঋণের অর্থও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হিসাবে না দিয়েও পিকে সিন্ডিকেটের ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে জমা হতো। এভাবে ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।
এমডি রাসেলের এক স্বাক্ষরেই ৭০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। এসব ঋণের অর্থ ওই কাগুজে প্রতিষ্ঠাগুলোর বিভিন্ন হিসাবে জমা হয়।
কাগুজে প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এসএ এন্টারপ্রাইজ, মুন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, সুখাদা প্রোপার্টিজ লিমিটেড, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, দিয়া শিপিং লিমিটেড, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, মেসার্স বর্ন, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, দ্রিনান অ্যাপারেলস, এন্ডবি এন্টারপ্রাইজ, এমার এন্টারপ্রাইজ, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা, হাল ইন্টারন্যাশনাল, মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেড, আর্থস্কোপ ও এমটিবি মেরিন।
এদিকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ঋণগুলোর প্রকৃত মালিকরা পলাতক রয়েছেন। আর ঋণের বিপরীতে কোনো প্রকার মর্টগেজও নেই। তাই ঋণের অর্থ আদায় করা অনিশ্চিত।
পিকে হালদারের অবৈধ সম্পদের মামলা : চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ২৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। একই দিন তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল।
পিকে হালদারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন আদালত। বছরের শুরুতেই তিনি বিদেশে পালান। তার বিরুদ্ধে করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে।
অন্যান্য মামলা, গ্রেফতার ও স্বীকারোক্তি : ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ভুয়া ঋণের নামে আত্মসাতের অভিযোগে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা হয়েছে।
৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় পিকে হালদারসহ অন্যদের আসামি করা হয়। ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে এ পর্যন্ত ১১ জন গ্রেফতার হয়েছে।
তাদের মধ্যে পিকের অন্যতম সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধা আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে আসামিরা কারাগারে আছে।
সূত্র: যুগান্তর