রেয়াত সুবিধার অপব্যবহার বন্ধে রিটার্নে প্রদর্শিত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ লক্ষ্যে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে প্রত্যেক কর অঞ্চলকে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। ১১ আগস্ট কর অঞ্চলগুলোকে সঞ্চয় অধিদপ্তরের ডেটাবেজ থেকে করদাতাদের বিনিয়োগের সত্যতা যাচাই করে ১৫ দিন অন্তর প্রতিবেদন আকারে এনবিআরে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সঞ্চয়পত্র কিনলে কর ছাড় পাওয়া যায়। একজন করদাতা বর্তমানে বার্ষিক আয়ের ২৫ শতাংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে তার বিপরীতে ১৫ শতাংশ কর রেয়াত পেয়ে থাকেন। এর বেশি কিনলেও তা রেয়াতযোগ্য হিসাবে গণ্য করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তির বার্ষিক আয় চার লাখ টাকা থাকলে এক লাখ বিনিয়োগ কর রেয়াতযোগ্য হিসাবে গণ্য হবে। সে হিসাবে তিনি ১৫ হাজার টাকা কর ছাড় পাবেন।
কর অঞ্চলগুলোয় পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে পাঠানো ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে করদাতাদের সঞ্চয়পত্র সংক্রান্ত বিনিয়োগের সঠিকতা যাচাইয়ের মাধ্যমে করজাল বৃদ্ধি, ডেস্ক অডিট, ফিল্ড অডিটসহ আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ সহজতর হবে। তবে প্রান্তিক বিনিয়োগকারীসহ করদাতারা যেন কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য কার্যক্রমটি পরিদর্শী কর্মকর্তাদের (যুগ্ম ও অতিরিক্ত কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তা) তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করতে হবে।
একই সঙ্গে চিঠিতে ছক আকারে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে। করদাতার নাম ও টিআইএন, আয়বর্ষ, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ, রিটার্ন দাখিল করেছে কিনা, আয়কর রিটার্নে প্রদর্শিত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের অঙ্ক উল্লেখ করে ১৫ দিন অন্তর প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
১০ মার্চ প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছিলেন, করদাতা সঞ্চয়পত্রে কত টাকা বিনিয়োগ করেছেন, সে অনুযায়ী রিটার্ন এবং কর দিয়েছে কি না, সেসব খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব মাধ্যম কাজে লাগিয়ে করজাল বৃদ্ধি এবং সঠিক কর নির্ধারণের প্রচেষ্টা চলছে। কারা কত টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছে? কত টাকার সঞ্চয়পত্র আছে? তার রিটার্নের চেহারা কী? এমনকি সঞ্চয়পত্রের সম্পদের হিসাবটা দেখানো হয়েছে কি না-এগুলোও খতিয়ে দেখব। এটি করা গেলে করহার কমানো যেতে পারে।
এনবিআর সূত্র জানায়, প্রতিবছর রিটার্ন জমা দেওয়া করদাতাদের বড় একটি অংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের বিপরীতে কর রেয়াত দাবি করে। এতদিন কর বিভাগের পক্ষে বিনিয়োগের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। করদাতার আদৌ ঘোষিত বিনিয়োগ আছে, নাকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে কর রেয়াত নিয়েছে, তা-ও নিরূপণ করা যেত না। কেবল সন্দেহ হলে ‘কেস-টু-কেস’ ভিত্তিতে সঞ্চয় অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে বিনিয়োগের সঠিকতা যাচাই করা হতো। এ কারণে সঞ্চয়পত্রে কর রেয়াতের অপব্যবহার হতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর অঞ্চল ১৫-এর একজন উপকমিশনার বলেন, এখন করদাতার ঘোষিত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ যাচাই করা যায় না। বিশ্বাসের ভিত্তিতেই দাবি অনুযায়ী রেয়াত দেওয়া হয়। অনেক ভুয়া বিনিয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই জালিয়াতি বন্ধে সঞ্চয় অধিদপ্তরের সিস্টেমের সঙ্গে সমন্বয় খুবই জরুরি। এর বাইরেও নানাভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের অপব্যবহার হচ্ছে। যেমন শুধু রেয়াত নেওয়ার জন্য রিটার্ন জমার আগে অনেকে সঞ্চয়পত্র কেনেন। রিটার্ন জমার পর বিক্রি করে দেন। এটি গুরুতর অনিয়ম। সরকারকে ধোঁকা দেওয়ার শামিল।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বহুদিন আগে থেকেই আমরা সব ধরনের লেনদেনকে অটোমেশনের আওতায় আনার কথা বলে আসছি। দেরিতে হলেও সরকার এদিকে মনোযোগ দেওয়ায় সাধুবাদ জানাই। তবে এই অটোমেশন বা ইন্টিগ্রেশনে সব সংস্থার সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনি বাধা থাকলে তা দূর করতে হবে। তাহলে ভালো সুফল পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, সরকার অটোমেশন সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে একদিকে যেমন রাজস্ব আদায় বহুলাংশে বাড়বে, অন্যদিকে অসৎ মানুষের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা থাকলে সেটি বন্ধ হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। এতে সরকারি দুই সংস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়বে। কারণ অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় না, হলেও তা অত্যন্ত ধীরগতিতে। এ কারণে চূড়ান্তভাবে জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি আরও বলেন, নতুন উদ্যোগে ভুয়া বিনিয়োগ ধরা পড়বে। যাদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিপ্রায় নেই, তাদের জন্যও এই ইন্টিগ্রেশন ভালো হবে বলে মনে করি।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা দেওয়া হয়। একক নামে বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ৩০ লাখ ও যৌথ নামে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ঊর্ধ্বসীমা নেই। এছাড়া তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। এর মেয়াদ তিন বছর। একক নামে এ সঞ্চয়পত্রে ৩০ লাখ ও যৌথ নামে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। আর পরিবার সঞ্চয়পত্র শুধু নারীরা কিনতে পারেন। একক নামে ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কেনা যায়। এর মেয়াদ পাঁচ বছর। পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ।
এছাড়া পেনশনার সঞ্চয়পত্র শুধু অবসরপ্রাপ্ত সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী/স্ত্রী/সন্তান কিনতে পারবেন। একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। তিন মাস অন্তর ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে মুনাফা দেওয়া হয়। অবশ্য সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে যে মুনাফা দেওয়া হয়, তা থেকে উৎসে কর হিসাবে ৫-১০ শতাংশ অর্থ কেটে রাখা হয়।
সূত্র: যুগান্তর