গ্রাহকের দায়-দেনাসহ ব্যবসার যাবতীয় নথিপত্র চেয়ে ইভ্যালির কাছে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ই-কমার্স খাতের আলোচিত-সমালোচিত ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি এবং সিইও মো. রাসেলের কাছে এসব নথিপত্র চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে এক সপ্তাহের বেশি সময় আগে। চিঠিতে স্বাক্ষর রয়েছে ইভ্যালির অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান টিমের প্রধান দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীর। চিঠি পাওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে ওই সব নথি পাঠাতে বলা হয়েছে।
চিঠি পাওয়ার পর ইভ্যালি থেকে কোম্পানি ও ব্যবসার এবং অনুমোদন-সংক্রান্ত কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক, সিটি করপোরেশন ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) অনুমোদন-সংক্রান্ত নথিগুলো রয়েছে।
অন্য নথিপত্রগুলো দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সময় চেয়ে নিয়েছে। অনুসন্ধান টিমের অন্য কর্মকর্তা হলেন, দুদকের উপসহকারী পরিচালক সিহাব সালাম।
দুদকের চিঠিতে ইভ্যালি কর্তৃপক্ষের কাছে চাওয়া তথ্য তালিকার মধ্যে রয়েছে- কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনার জন্য সব ধরনের লাইসেন্স; ব্যবসায়িক মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য, কতগুলো ক্রয় আদেশের বিপরীতে পণ্য সরবরাহ করা হয়নি, ওই সব আদেশের বিপরীতে টাকার পরিমাণ কত, ক্রেতার আদেশের বিপরীতে বকেয়া কীভাবে হলো, কোন পদ্ধতিতে হলো- এসব তথ্য; গ্রাহকের দায় শোধ করতে তাদের পরিকল্পনা, বিদ্যমান ব্যবসায়িক সংকট মোকাবিলায় তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং ব্যাংকের ঋণসহ (যদি থাকে) সব রকম দায়-দেনার হিসাব।
এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শুরু হওয়ার পর ইভ্যালি এ পর্যন্ত কতজন গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করেছে, কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কত টাকার ভ্যাট, ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন অর্থবছরে কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদন, কোম্পানির সার্বিক খরচের হিসাব, কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খরচ হওয়া অর্থের উৎস, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পণ্যের অফারে এ পর্যন্ত গ্রাহকদের ছাড় দেওয়া টাকার পরিমাণ, এ পর্যন্ত যত টাকার অফার দেওয়া হয়েছে, তার মোট মূল্যের হিসাব- এসবও জানতে চেয়েছে দুদক।
ই-কমার্স খাতের এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ হলে বঞ্চিত গ্রাহকরা তাদের পাওনা অর্থ ফেরত পাবে না। গ্রাহক যাতে পাওনা টাকা ফেরত পায়- অনিয়ম ও দুর্নীতি অনুসন্ধানের পাশাপাশি দুদক এই বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছে। ইভ্যালি ইতোমধ্যে জানিয়েছে, সারাদেশে তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৭০ লাখ।
ইভ্যালি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চলমান তদন্তের দিকেও খেয়াল রাখছে দুদক। প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম, দুর্নীতিসহ সার্বিক কার্যক্রম তদন্ত করতে এই মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি কাজ করছে। এরই মধ্যে ইভ্যালির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্যও নিয়েছে কমিটি। তদন্ত শেষে মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নেবে, সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাও সংগ্রহ করবে দুদক।
দুদকের চাহিদাপত্র অনুযায়ী সব ধরনের নথিপত্র সরবরাহ করা হলে সেগুলো যাচাই করা হবে। এসব ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের কাজ শেষে অভিযোগ সম্পর্কে ইভ্যালির এমডি ও সিইও মো. রাসেল এবং প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. রাসেলের স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুরো অনুসন্ধান শেষে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে জড়িত শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যক্তি ও মার্চেন্ট পর্যায়ের গ্রাহকদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৩৩৮ কোটি টাকা। ওই পরিমাণ অর্থ তাদের ব্যাংক হিসাব থেকে সরিয়ে ফেলে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত বছরের শুরুর দিকে দুদক ইভ্যালির বিরুদ্ধে গ্রাহক প্রতারণার অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে। তখন অভিযোগটির অনুসন্ধান চলছিল ধীরগতিতে। একই বছরের শেষ দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইভ্যালির বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের তদন্ত শেষ করে। মন্ত্রণালয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠায়। তখন দুদকের অনুসন্ধানে গতি পায়। পরে মন্ত্রণালয় গত ৭ জুলাই আরেকটি তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় দুদকে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ইভ্যালির প্রতারণা-সংক্রান্ত কিছু নথি পাঠানো হয় দুদকে।
ইভ্যালি ই-কমার্স ব্যবসার জন্য নিবন্ধন নেয় ২০১৮ সালের ১৪ মে। আনুষ্ঠানিক ব্যবসা শুরু করে একই বছরের ডিসেম্বর থেকে। শুরুতেই তারা নানা ধরনের পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় অফার দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক কম মূল্যে একের পর এক পণ্য বিক্রির অফার দিতে থাকে তারা। কিছু গ্রাহককে বড় অঙ্কের ডিসকাউন্ট দিয়ে পণ্য সরবরাহ করে এই প্রচারণা চালানো হতো। ২০০ থেকে ৩০০ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট অফারও ছিল তাদের। অসংখ্য গ্রাহক কম দামে পণ্য কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কিন্তু পণ্যের মূল্য পরিশোধ করলেও তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত পণ্য এখনও পাননি।
সূত্র: সমকাল