তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। থাকেন সরকারি আবাসিক এলাকায়। কিন্তু তার ভয়ে অন্য বাসিন্দারা তটস্থ। নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার চেয়ে এরই মধ্যে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে রয়েছেন যুগ্ম সচিব, চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেট, অধ্যক্ষের মতো পদস্থ লোকজন।
সরকারি ওই কর্মকর্তার নাম মো. লোকমান আহমেদ। তিনি প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা; বর্তমানে পদমর্যাদা উপসচিব। থাকেন রাজধানীর বেইলি রোডের সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারে। এখন পর্যন্ত রমনা ও মতিঝিল থানায় তার বিরুদ্ধে ১২টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। জিডির বাদীদের মধ্যে পাঁচজন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, লোকমান আহমেদ কয়েকজনকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। অনেককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। কারও গাড়ির গ্যারেজে আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন। এ ছাড়া প্রায়ই লাঠি ও ব্যাট নিয়ে বাসিন্দাদের মারতে উদ্যত হন। যখন-তখন গালমন্দ করেন অকথ্য ভাষায়।
চলতি বছরের ১৮ মে উপসচিব লোকমানের বিরুদ্ধে জিডি করেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের উপসচিব মো. হাসানুজ্জামান। জিডিতে তিনি বলেন, গত ৯ মে ভোর সোয়া ৫টায় লোকমান টেলিফোনে
তাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। ছেলেমেয়েকে হত্যার হুমকি দেন। তাদের কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যেতে বলেন। এরপর ১৮ মে আবার টেলিফোনে গালমন্দ, ছেলেমেয়েসহ তাকে হত্যার ভয় দেখান।
জিডিতে এও বলা হয়, লোকমান কোয়ার্টারের অনেক বাসিন্দাকে এরই মধ্যে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। তার ভয়ে সবাই তটস্থ।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল লোকমানের বিরুদ্ধে আরেকটি জিডি করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী। জিডিতে তিনি বলেন, ২২ এপ্রিল সকাল সোয়া ৭টার দিকে কোয়ার্টারের ৯ ও ১১ নম্বর ভবনের মাঝে প্রাতঃভ্রমণকালে লোকমান একটি লাঠি নিয়ে তার দিকে ছুটে আসছিলেন। এরপর নিরাপত্তারক্ষী আলাউদ্দিন ও মোশারফকে ডাক দেন সুবোধ। দু’জন গিয়ে লোকমানের গতিরোধ করেন। যুগ্ম সচিবকে হত্যা ও তার গ্যারেজে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন ওই উপসচিব। এ ছাড়া তার স্ত্রীকেও অশালীন ভাষায় গালমন্দ করেন।
লোকমান সব সময় দা, লাঠি, ক্রিকেট ব্যাট হাতে কোয়ার্টার এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন বলে জিডিতে অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, শিশু-কিশোররা ভয়ে অনেক সময় বাসা থেকে নিচে নামতে পারে না।
এই উপসচিবের বিরুদ্ধে জিডির আরেক বাদী হলেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. রেবেকা সুলতানা। তার অভিযোগ, প্রায়ই রেবেকা ও তার স্বামী মনজুর মোর্শেদকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন লোকমান। এ ছাড়া জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধানকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে রেবেকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। এ ছাড়া ৪ মে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালককে ফোন করে অতিরিক্ত সচিব পরিচয় দিয়ে রেবেকার স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন লোকমান। ওই গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত আছেন রেবেকার স্বামী।
গত ৫ মে লোকমানের বিরুদ্ধে জিডি করেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডা. মোহাম্মদ মনজুর মোর্শেদও। জিডিতে তিনি বলেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার ডিএস পরিচয় দিয়ে মনজুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তার প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে নির্দেশ দেন লোকমান। আরেক দিন নিজেকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পরিচয় দিয়ে একই ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে বেইলি স্কয়ারের সরকারি কোয়ার্টারে নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে এটা জানিয়ে পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে লোকমান আহমেদের বিরুদ্ধে জিডি করেছেন সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. অসীম কৃষ্ণ চৌধুরী। জিডিতে তিনি বলেন, লোকমান প্রায়ই আমার জন্য বরাদ্দ করা সরকারি গাড়ির চালক আব্দুল খালেককে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। চলতি বছরের ১২ মে খালেককে উদ্দেশ করে লোকমান বলেন, ‘তোর বসকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে এসে এনকাউন্টারে করে হত্যা করা হবে।’ ১৬ মে সকালে অসীম কৃষ্ণ, তার স্ত্রী ও সন্তানকে জীবননাশের হুমকি দেন ওই উপসচিব। এ ছাড়া চলতি বছরই ওই কোয়ার্টারে বসবাসকারী আরেক সরকারি কর্মকর্তাকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মারতে উদ্যত হন লোকমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি লোকমানের বিরুদ্ধে রমনা থানায় জিডি করেন ওই সময় গাজীপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আস্সামছ জগলুল হোসেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, লোকমান তার গাড়িচালক জনি চন্দ্র মল্লিককে প্রায়ই অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। এমনকি গাড়িটি পুড়িয়ে ফেলাসহ চালককে হত্যার হুমকিও দিয়ে আসছেন তিনি। জনি বিষয়টি লিখিতভাবে কোয়ার্টারের সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অবহিত করেন। ২০১৭ সালে লোকমানের ব্যাপারে আরেকটি জিডি করেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডা. শেখর কুমার মণ্ডল।
লোকমানের বিরুদ্ধে করা একাধিক জিডির তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার এসআই মুরাদ খান। তদন্তের অগ্রগতির ব্যাপারে মুরাদ বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে জিডি করা হলে আদালতের অনুমতি নিয়ে তদন্ত করতে হয়। লোকমানের বিরুদ্ধে করা জিডির তদন্তের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে হয়তো অনুমতি পেতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।’
পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, উপসচিবের বিরুদ্ধে করা জিডির তদন্ত শেষে যা পাওয়া যাবে সেই আলোকে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
অভিযোগের ব্যাপারে উপসচিব লোকমান আহমেদের মোবাইল ফোনে কল করে সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি এক পর্যায়ে লাইন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এরপর বক্তব্য জানতে তার ফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও তার সাড়া মেলেনি।
চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-১ শাখা থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (উপসচিব) লোকমান আহমেদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অসদাচরণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা-আপিল) বিধিমালা-২০১৮-এর বিধি ৩ (খ) ধারা অনুযায়ী বিভাগী ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা প্রয়োজন ও সমীচীন মনে করে।
একই তারিখে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা পত্রে বলা হয়, লোকমানের ব্যাপারে উত্থাপিত অভিযোগ সরকারি আবাসন পরিদপ্তর থেকে তদন্ত করানো হয়। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে বাংলাদেশ বরাদ্দ নীতিমালা ১৯৮২ অনুযায়ী লোকমানের নামে বেইলি রোডের অফিসার্স কোয়ার্টারের ১৬/১১ নম্বর বাসার বরাদ্দ বাতিল করা হয়।
এ ছাড়া সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, লোকমান উপদ্রব সৃষ্টি করে আবাসন এলাকায় বসবাসের পরিবেশ নষ্ট করেছেন। তবে বরাদ্দ বাতিলের পরও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লোকমান আহমেদ তার সরকারি বাসায় থাকছেন।
লোকমানের বিরুদ্ধে যারা জিডি করেছেন তাদের মধ্যে তিনজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তার বলছেন, একটি আবাসিক এলাকায় একজন সরকারি কর্মকর্তার এমন আচরণ দুঃখজনক। তাদের ভাষ্য, লোকমানের ভেতরে এক ধরনের অহংবোধ কাজ করছে। আর মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ।
সূত্র: সমকাল