সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামে গতকাল শনিবার সকাল ৮টায় নববধূ শারমিন আক্তারের দাফন সম্পন্ন হয়। মাত্র এক সপ্তাহ আগে ২০ আগস্ট মৃত জারু মিয়ার কন্যা শারমিনের বিয়ে হয়েছিল বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের আউলিয়া বাজারের জহিরুল ইসলামের সঙ্গে। বিয়ের পর এই প্রথম নববধূকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন জহির। তাদের দাম্পত্য জীবনের চিরসমাপ্তি ঘটল মর্মান্তিক ওই নৌ-দুর্ঘটনায়। নবপরিণীতা স্ত্রীকে হারিয়ে জহির এখন পাগলপ্রায়।
গতকাল সকাল ৯টায় ভাটপাড়ায় শারমিনদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, শোকে স্তব্ধ পুরো বাড়ি। সেখানে স্বামী জহিরের আহাজারিতে কান্না ধরে রাখতে পারেননি বাড়িতে আসা দর্শনার্থীরাও। আহাজারি করতে করতে জহির জানান, তারা বিকেল পৌনে ৪টায় নৌকায় ওঠেন। চম্পকনগর ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ে পৌনে ৫টায়। চালককে বারণ করা সত্ত্বেও জায়গা জায়গায় যাত্রী ওঠায়। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে দুর্ঘটনার ১৫ মিনিট আগে আরেকটি নৌকার সঙ্গে ধাক্কা লাগে তাদের নৌকার। এ সময় যাত্রীরা চালককে ধীরে নৌকা চালানোর কথা বললেও তিনি গতি বাড়িয়ে দেন। এর পরপরই বালিবোঝাই ট্রলারের সঙ্গে তাদের নৌকার সংঘর্ষ হয়। এ দুর্ঘটনায় যাত্রীবাহী নৌকার চালককে দায়ী করে জহির তার বিচার দাবি করেন।
জহিরের বড় ভাই শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি বলেছিলাম নতুন বউকে সিএনজি দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বউ নৌকায় যেতে শখ করায় তারা এ পথে আসতে গিয়ে সব শেষ হয়ে গেল! নিহত শারমিনের চাচা নূরু মিয়া বলেন, ১৫ বছর আগে ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে শারমিন ও তার ভাইকে নিজের সন্তানের মতো বড় করেছি। আজ ভাতিজির এ পরিণতি দেখতে হলো আমাকে! শারমিনের মা জ্যোৎস্না বেগম শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
দুপুরে বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগরের গেরারগাঁওয়ে স্বজনহারা জজ মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে কান্নার রোল। শুক্রবার স্ত্রী-কন্যা ও শাশুড়িকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাওয়ার পথে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় সবাইকে হারান জজ মিয়া। তার স্ত্রী ফরিদা বেগম, কন্যা মুন্নী ও শাশুড়ি কমলা বেগমকে দাফন করে মাত্র ঘরে ফিরেছেন স্বজনরা। জজ মিয়া বলেন, কাতার প্রবাসী ছেলেকে তার মা বাড়ি আসার সময় স্বর্ণালঙ্কার আনতে বলে। ছেলে মায়ের জন্য ৬০ হাজার টাকার স্বর্ণালংকার কিনে রেখেছে। দুর্ঘটনার খবর শুনে সে এখন বাড়ি আসছে। জজ মিয়া আহাজারি করতে করতে বলেন, ছেলের স্বর্ণ এখন কে পরবে!
লইস্কার বিলের জলে ধুয়ে গেল মামুনের স্বপ্ন :চম্পকনগরের ফতেপুর গ্রামের প্রবাসী জহিরুল হক ভূঁইয়া ওরফে খালেদ ভূঁইয়ার বড় ছেলে আরিফ বিল্লাহ মামুন ভূঁইয়া (২১) মেধাবী তরুণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি ও কুমিল্লার ইস্পাহানী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। সে লক্ষ্যে ঢাকার গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজে দ্বাদশ ব্যাচে ভর্তি হয়েছিলেন। শুক্রবারের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তার চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন লইস্কার বিলের জলে ভেসে গেছে।
গতকাল দুপুরে মামুনদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে সুনসান নীরবতা। সুরম্য বাড়ির সামনে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে তার নিথর দেহ। কারও মুখে কথা নেই। সবাই প্রবাসী বাবা-মায়ের জন্য অপেক্ষায়। তারা বাড়ি এলে আজ রোববার মামুনের লাশ দাফন সম্পন্ন হবে বলে স্বজনরা জানান।
যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে :ঘটনার দিন ২১ জনের মরদেহ উদ্ধারের পর রাত ২টার দিকে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও ফায়ার সার্ভিস। গতকাল সকালে উদ্ধার অভিযানে নেমে বিআইডব্লিউটিএ ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল পৌনে ১০টার দিকে নিখোঁজ শিশু নাশরার (৩) লাশ উদ্ধার করে। নাশরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার উত্তর পৈরতলার হারিজ মিয়ার মেয়ে।
নিহত অন্যরা হলেন- সদর উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের চিলোকূট গ্রামের আবদুল্লাহর মেয়ে তাকওয়া (৮), বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের জহিরুল হক ভূঁইয়ার ছেলে আরিফ বিল্লাহ মামুন ভূঁইয়া (২০), গেরারগাঁওয়ের মৃত কালু মিয়ার স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৬০), জজ মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪০), কন্যা মুন্নী (৬), শাশুড়ি কমলা বেগম ওরফে রৌশনারা (৬০), নূরপুর গ্রামের মৃত আবদুর রাজ্জাক ওরফে মন মিয়ার স্ত্রী মিনারা বেগম, আদমপুর গ্রামের পরিমল বিশ্বাসের স্ত্রী অঞ্জলি বিশ্বাস (৩০), মেয়ে ত্রিদিবা (২), ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার দক্ষিণ পৈরতলার আবু সাঈদের স্ত্রী মোমেনা বেগম (৫৫), সদর উপজেলার সাদেকপুর গ্রামের মুরাদ হোসেনের ছেলে তানভীর (৮), একই উপজেলার গাছতলা গ্রামের জামাল মিয়ার ছেলে সাজিম (৭), নাটাই উত্তর ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের জারু মিয়ার মেয়ে শারমিন (১৮), উত্তর পৈরতলার ফারুক মিয়ার স্ত্রী কাজলী বেগম, পৌর এলাকার দাতিয়ারার মোবারক মিয়ার মেয়ে তাসফিয়া মীম (১২), ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর গ্রামের খোকন মিয়ার স্ত্রী ঝর্ণা বেগম (৫৫), একই গ্রামের শাওন মিয়ার ছেলে সাজিদ (৩), বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত আবদুল বারীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম শিরু (৫৮), বাদেহারিয়া গ্রামের কামাল হোসেনের মেয়ে মাইদা আক্তার (৬), পত্তন ইউনিয়নের বড়পুকুরপাড় গ্রামের সোলায়মান মিয়ার স্ত্রী রুবিনা আক্তার ও সোনাবর্ষিপাড়া গ্রামের আবদুল বারী ভূঁইয়ার স্ত্রী নুসরাত জাহান।
মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার ৫ :দুর্ঘটনার কারণে ওই নৌপথে নৌ-চলাচল সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। বিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাবেয়া আফসার সায়মা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় আবার চালু করা হবে।
এদিকে নৌকাডুবিতে মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল দুপুরে বিজয়নগর থানায় মামলা হয়েছে। উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের মৃত আবদুল হাসিমের ছেলে সেলিম মিয়া বাদী হয়ে সাতজনকে আসামি করে এ মামলা করেন। পুলিশ শুক্রবার রাতে তিনজন ও গতকাল দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন- বালুবাহী ট্রলারের চালক সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের শোলাবাড়ি গ্রামের জমির মিয়া, শ্রমিক একই এলাকার মো. রাসেল, খোকন মিয়া, মো. সোলায়মান ও বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের কালারটেক গ্রামের মিষ্টু মিয়া। তাদের সবাইকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হোসেন রেজা।
ঘটনাস্থলে তদন্ত কমিটি :জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। একই সঙ্গে তারা নিহতদের বাড়ি গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, আমরা নৌকার ডিজাইন, ফিটনেস, অতিরিক্ত যাত্রী ছিল কিনা- সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ১০ কর্মদিবসের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেব। তিনি আরও বলেন, ডুবুরি দল আমাকে নিশ্চিত করেছে- নৌকার ভেতরে আর কোনো মরদেহ নেই। এ ছাড়া ডুবে যাওয়া নৌকাটি উদ্ধারে এ মুহূর্তে আমাদের কাছে তেমন সরঞ্জাম নেই। বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী যানও এখানে আনা সম্ভব নয়। তাই নৌকাটির দুর্ঘটনাস্থল লাল কাপড় দিয়ে চিহ্নিত করে উদ্ধার কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে থাকা বিআইডব্লিউটিএ আশুগঞ্জ ভৈরব নৌবন্দরের উপপরিচালক শহীদুল হক বলেন, এ নৌপথের কোনো নৌযানের নিবন্ধন বা অনুমোদন নেই। নৌযানগুলোর চালকদেরও কোনো প্রশিক্ষণ নেই। অদক্ষ চালক দিয়ে নৌকা চালানোর কারণেই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
সূত্র: সমকাল