শেয়ারবাজারে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে কারসাজির তথ্য মিলেছে। একটি মার্চেন্ট ব্যাংক ও একটি ব্রোকারেজ হাউজে ৬টি নামে মোট ১১টি বিও অ্যাকাউন্ট খুলে কোম্পানির ৩২ শতাংশ শেয়ার আটকে দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে চিহ্নিত একটি চক্র। আর এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম বেড়ে সাড়ে সাত গুণ হয়েছে।
আর নেতৃত্ব দিয়েছেন সফিউল্লাহ মিজান (শেয়ারবাজারে বিমা মিজান নামে পরিচিত) নামে একজন বিনিয়োগকারী। আর বর্তমানে চক্রটি প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
তবে ইতোমধ্যে শেষবারের মতো তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর আগেও কয়েকবার সতর্ক করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ বলেন, কে কোন কোম্পানির শেয়ার কিনল, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, বাজারে সবাইকে আইনের মধ্যে থাকতে হবে।
কেউ আইন লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তার মতে, শুধু বিএসইসি একা নয়, বাজারের উন্নয়নে সব পক্ষ থেকে যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে।
দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাজারে বিমার শেয়ারের ওঠানামার সঙ্গে মিজানের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক মাসে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কিনে আটকায় মিজান সিন্ডিকেট।
ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএল (সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড) সূত্রে জানা যায়, সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেস লিমিটেড এবং ভার্টেক্স স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজে ৬টি মোট ১১টি অ্যাকাউন্ট খোলে চক্রটি।
এক্ষেত্রে সফিউল্লাহ মিজানের ছোট এজি মাহমুদের নামে খোলা হয় একটি অ্যাকাউন্ট। বর্তমানে এই অ্যাকাউন্টে প্রভাতীর ৭ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে। সিবিসিআরএল ক্লায়েন্টের নামে তিন অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আরও তিনটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে টেকবাই ইন্টারন্যাশনালের নামে।
প্রোসয়েল ফাউন্ডেশন কনসালটেন্টের নামে রয়েছে দুটি অ্যাকাউন্ট। ভার্টেক্স স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়েস সালেহীনের নামে রয়েছে আরও ২টি অ্যাকাউন্ট। এর সবই এই চক্র খুলেছে। বর্তমানে এই ১১টি অ্যাকাউন্টে ৩২ শতাংশ শেয়ারের তথ্য মিলেছে।
জানতে চাইলে সফিউল্লাহ মিজান শনিবার বলেন, একজন ব্যক্তি বিনিয়োগকারী একটি কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারে না। আর প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ১০ শতাংশের নিচে।
এরপর কেউ যদি আমার ব্যাপারে অপপ্রচার করে, সেটি সঠিক নয়। এজি মাহমুদের ব্যাপারে তিনি বলেন, সে আমার ভাই। কিন্তু সে ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগ করে।
আমার সঙ্গে এই বিনিয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই। সফিউল্লাহ মিজান আরও বলেন, এই বাজারের দুঃসময়ে আমি যে সাপোর্ট দিয়েছি, তা সবাই জানে।
প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের পর্ষদে যাচ্ছেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পর্ষদে যাওয়ার কোনো চিন্তাভাবনা আমার নেই। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, এরা সবাই ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
জানা যায়, এক বছর সময় নিয়ে ওই চক্রটি প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সে কারসাজি করে। শুরুতে সামান্য শেয়ার কিনলেও চলতি বছরের ১১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারে কারসাজির বিষয়টি সামনে আসে।
এদিন হঠাৎ করেই ব্লক মার্কেটে ১৯টি অর্ডারে, কোম্পানির ৬২ লাখ ৬৭ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়। যার মোট মূল্য ছিল ৭৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
ওইদিন বাজারে মোট ৪৫৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়। যার প্রায় ১৭ শতাংশই ছিল এই কোম্পানির। ১৫ এপ্রিল কোম্পানিটির ব্লক মার্কেটে তিনটি অর্ডারে কোম্পানিটির ২ লাখ ২৫ হাজার ৮০০ শেয়ার লেনদেন হয়।
যার মোট মূল্য ছিল ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এভাবে ব্লক এবং মূল মার্কেটে কোম্পানির শেয়ার অস্বাভাবিকভাবে লেনদেন হতে থাকে।
আর উল্লিখিত শেয়ার কিনে আটকাতে মাত্র ৩ মাস সময় নেয় তারা। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে কিনেছে, তার বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব নেই। টেকবাই ইন্টারন্যাশনালের শুধু একটি ফেসবুক পেজ পাওয়া গেছে।
তবে রাজধানীর ৮৮টি ইন্ধিরা রোডে প্রোসয়েল ফাউন্ডেশনের অফিস। এর রোড নং ১৪ এবং প্লট ৭৯টি। সেখানে কোম্পানির ধরন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং।
কোম্পানির ওয়েবসাইটে রবি একটি নম্বর দেওয়া আছে। তবে ফোন নম্বরে কল করা হলে বলা হয়, শেয়ারবাজারে তাদের কোনো ব্যবসা নেই। তবে অপর প্রান্তে যিনি কথা বলেছেন, তিনি তার পরিচয় দিতে চাননি।
এদিকে এক বছরের কম সময়ে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর কোম্পানির ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ২৮ টাকা। বর্তমানে তা ১৮০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে শেয়ারটির দাম বাড়ছে সাড়ে ৬ গুণ।
জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বিমা কোম্পানিরগুলোর উদ্যোক্তাদের শেয়ার ধারণের ব্যাপারে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইডিআরএ)। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিমা কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তাদের ৬০ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক।
সংস্থাটির এই প্রজ্ঞাপনটিই বিমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে অন্যতম সহায়ক হিসাবে কাজ করেছে। কারণ এই প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়ন করতে হলে বাজারে শেয়ার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হবে। এক মাসের নির্দেশনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও বেশির ভাগ কোম্পানিই তা করতে পারেনি।
এদিকে বর্তমানে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তাদের কাছে ৩০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে ১৯ দশমিক ১৯ শতাংশ। বাকি প্রায় ৫১ শতাংশ শেয়ারের অধিকাংশই বিভিন্ন নামে, বেনামে কিনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে চক্রটি।
এ অবস্থায় আইডিআরের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হলে কোম্পানিটির সামনে দুটি পথ। প্রথমত, কারসাজি চক্রের সঙ্গে সমাঝোতা করে উচ্চ দামে শেয়ার কিনতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই চক্রটিকে উদ্যোক্তা হিসাবে পর্ষদে নিতে হবে।
তবে এ ব্যাপারে কথা বলতে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সূত্র: যুগান্তর