আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী বিদায় নেওয়ার পর এরই মধ্যে গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে তালেবান। তাদের সশস্ত্র উত্থানের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে দেশটির একের পর এক প্রদেশ। এখন চলছে দুই দশক পর আবার আফগানিস্তানে তালেবান সরকার গঠনের প্রক্রিয়া। কিন্তু তালেবানের এই অগ্রযাত্রায় কাঁটার মতো বাধা হয়ে আছে আফগানিস্তানের পাঁচ সিংহের অঞ্চল বলে খ্যাত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পাঞ্জশির। এরই মধ্যে তালেবান গোটা প্রদেশ ঘিরে ফেললেও পাঞ্জশিরকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি।
রাজধানী কাবুলের উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালায় অবস্থিত পাঞ্জশিরে অবস্থান করে তালেবানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন প্রয়াত আফগান মুজাহিদিন কমান্ডার শাহ আহমেদ মাসউদের ছেলে ন্যাশনাল রেসিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (এনআরএফ) নেতা আহমদ মাসউদ। এ ছাড়া সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন উৎখাত হওয়া সরকারের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী
বিসমিল্লাহ মোহাম্মদিও। কিন্তু দৃঢ়প্রত্যয়ের কারণে মাসউদই এখন হয়ে উঠেছেন গোটা আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী প্রতিরোধের প্রধান মুখ। কিন্তু গোটা পাঞ্জশিরকে ঘিরে ফেলে তালেবান যেভাবে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে এনআরএফের এই প্রতিরোধ আর কতক্ষণ টিকে থাকবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও ইতিহাস বলে, কোনো আগ্রাসী শক্তিই কখনো দখলে নিতে পারেনি পাঞ্জশিরকে। স্বাধীনচেতা পাঞ্জশিরের জনগণ সবসময় বেঁচেছেন সিংহের মতোই বীরবিক্রমে।
পাঞ্জশির শব্দের অর্থ পাঁচ সিংহ। ফারসি পাঞ্জ শের বা পাঁচ শের থেকে এই নামের উৎপত্তি। যার পেছনে রয়েছে দশম শতাব্দীর একটি আখ্যানও। জনশ্রুতি রয়েছে, দশম শতকে গজনির সুলতান মাহমুদের নির্দেশে পাঁচ ভাই মিলে এখানে প্রচ- পরিশ্রম করে বন্যার পানি ধরে রাখতে একটি বাঁধ তৈরি করেন। অসামান্য কৃতিত্বের জন্য এই পাঁচ ভাইকে তখন সিংহ বা শের উপাধি দেওয়া হয়। সেই থেকে এই উপত্যকা পাঁচ সিংহের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এর উত্তরে বাঘলান ও তখর প্রদেশ, পূর্বে বাদাখশন ও নুরিস্তান প্রদেশ, দক্ষিণে লাঘমান ও কাপিসা প্রদেশ এবং পশ্চিমে পারওয়ান প্রদেশ রয়েছে। সাত জেলায় বিভক্ত পাঞ্জশির ২০০৪ সালে পারওয়ান প্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইতিহাস বলে, কখনো এই অঞ্চলকে পদানত করতে পারেনি কোনো শক্তি। নব্বইয়ের দশকে যেমন নিজেদের প্রথম শাসনামলে তালেবানরা এটিকে দখলে নিতে পারেনি, তেমনি এরও এক দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যর্থ হয়েছে।
মূলত প্রাকৃতিকভাবে পার্বত্যাঞ্চল হওয়ায় পাঞ্জশিরের পথঘাট খুব দুর্গম। আর এই ভূপ্রকৃতিই পাঞ্জশিরকে করে তুলেছে বিভিন্ন প্রতিরোধ বাহিনীর প্রাকৃতিক দুর্গ। আফগানিস্তানের উত্তরের সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি পাঞ্জশির দিয়ে হওয়ায় উপত্যকাবাসী নানাবিধ ভৌগোলিক সুবিধা পায়। ফলে এই এলাকার নিয়ন্ত্রকদের অধীনে থাকে দেশের পুরো উত্তরাঞ্চল। সে জন্যই বিভিন্ন যোদ্ধা পাঞ্জশিরকে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।
তবে এবার তালেবানদের দ্বারা পাঞ্জশির বিপদের মধ্যে রয়েছে। আহমেদ মাসউদের এনআরএফ যোদ্ধারা প্রবল বিক্রমে প্রতিরোধ চালিয়ে গেলেও আরও উন্নত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তালেবানরা এগোচ্ছে প্রদেশের প্রধান শহর বাজারকের দিকে। বিবিসি জানায়, গতকাল শুক্রবারও পাঞ্জশিরের আশপাশে তালেবানদের সঙ্গে এনআরএফ যোদ্ধাদের তীব্র লড়াই হয়েছে। এরই মধ্যে প্রদেশটির বেশকিছু অঞ্চল দখলের দাবি করেছে তালেবান।
একই সঙ্গে তাদের হামলায় এনআরএফের অনেক সদস্য হতাহত হয়েছে বলেও দাবি করেছে তারা। তবে তালেবানের দাবি উড়িয়ে দিয়ে এনআরএফ বলেছে, প্রদেশের সব প্রবেশমুখে এখনো তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। বরং তাদের প্রতিরোধে শতাধিক তালেবান নিহত হয়েছে। এদিকে পাঞ্জশিরে হামলার আগে এনআরএফের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি জানান, সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরই তারা পাঞ্জশির অভিমুখে হামলা চালাচ্ছেন।
সূত্র: আমাদের সময়.কম