স্ট্রোক মস্তিষ্কের ভয়াবহ রোগ। বাংলাদেশে মৃত্যু ও বিকলাঙ্গের অন্যতম কারণ এই স্ট্রোক। মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত চলাচলের ব্যাঘাত ঘটলে বা রক্তক্ষরণ হলে এবং তা ২৪ ঘণ্টা স্থায়ী হলে তাকে স্ট্রোক বলে। মস্তিষ্কের কোষ অত্যন্ত সংবেদনশীল। সামান্য শর্করা ও অক্সিজেনের অভাবে কোষগুলো মারা যায়। ফলে পক্ষাঘাত, বিকলাঙ্গ এমনকি মৃত্যু হতে পারে। তবে এই ভয়াবহ রোগের চিকিৎসা রয়েছে। প্রতিরোধযোগ্যও করা যায়। তবে যে ভুল ধারণাটি প্রচলিত তা হলো- একবার স্ট্রোক হলে রোগীর স্ট্রোক প্রতিরোধের আর কোনো প্রয়োজন নেই। প্রকৃতপক্ষে প্রথম স্ট্রোকের পর স্ট্রোক প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ খুব গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম স্ট্রোকে আক্রান্ত প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ রোগী পুনরায় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, যা রোগীর পুনর্বাসন ও সুস্থ হয়ে ওঠার পথে বড় বাধা। তাই প্রথম স্ট্রোকের পর বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
একবার স্ট্রোক হওয়ার পর পুনরায় স্ট্রোক প্রতিরোধের প্রক্রিয়া সেকেন্ডারি স্ট্রোক প্রতিরোধ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটির মূল ধারণা হলো- স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে রোগীকে অবহিত করা। স্ট্রোকের ঝুঁকি ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না হলে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ জন্য একদিকে যেমন চিকিৎসা ও ওষুধ প্রয়োজন, অন্যদিকে জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস ও ফিজিওথেরাপির সমন্বয়ের মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ : প্রথম স্ট্রোকের পর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
রক্তে চর্বির পরিমাণ : রক্তে চর্বি বৃদ্ধি পাওয়া বা ডিসলিপিডেমিয়া স্ট্রোকে আক্রান্তের অন্যতম কারণ। রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণ শুধু স্ট্রোক প্রতিরোধ নয়, অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্যও দরকার। রক্তে চর্বি নিয়ন্ত্রণ শুধু ওষুধে নয়, খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চার মাধ্যমেও করা সম্ভব।
ডায়াবেটিস : যেসব স্ট্রোক রোগীর ডায়াবেটিস আছে, তাদের রক্তনালির সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, হাইপারলিপিডেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তাই যথাযোগ্য চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
স্থূলতা ও শারীরিক ব্যায়াম : হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং অকাল মৃত্যুহারের জন্য স্থূলতা অন্যতম ঝুঁকি। স্ট্রোক অথবা ট্রানসিয়েন্ট ইসচেমিক স্ট্রোকের প্রত্যেক রোগীকে বিএমআই নির্ণয়ের মাধ্যমে স্থূলতার জন্য পরীক্ষা করতে হবে। রোগীর ওজন কমাতে পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে নিবিড়, নিরবচ্ছিন্ন পরামর্শ প্রদান করতে হবে এবং পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর যত্ন নিতে হবে। যেসব রোগীর স্ট্রোক এবং টিআইএ হয়েছে এবং যারা শারীরিক পরিশ্রম করতে সক্ষম, তাদের সপ্তাহে ২-৪ বার মাঝারি থেকে ভারী এরোবিক শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। স্ট্রোকের পর যারা শারীরিক নিষ্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হন, তাদের স্বাস্থ্যকর্মী, যেমন- ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে শারীরিক ব্যায়াম কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে।
খাদ্য ও পুষ্টি : মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের মধ্যে রক্তে ভিটামিন-ডি এবং ডায়েটারি পটাসিয়ামের স্বল্পতা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেসব রোগীর স্ট্রোক অথবা টিআইএ হয়েছে এবং অপুষ্টির লক্ষণ রয়েছে, তাদের সুনির্দিষ্ট পুষ্টির জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। তাদের এমন খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতে হবে, যেখানে শাকসবজি, ফল, শস্যখাদ্য এবং চর্বির পরিমাণ কম এমন দুগ্ধপণ্য, মাছ, মুরগি, অলিভ অয়েল, বাদাম অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মিষ্টি এবং রেডমিট খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে। প্রতিদিনের সোডিয়ামের পরিমাণ ২.৪ গ্রাম/ডেসিলিটারের কম হতে হবে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস স্ট্রোক রোগীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রোগী স্বাভাবিকভাবে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না।
ধূমপান : ধূমপান স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। স্ট্রোক রোগী ধূমপায়ী হলে তার পুনরায় স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীর পুনরায় স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়। প্রথম স্ট্রোক হওয়ার পর পুনরায় স্ট্রোক প্রতিরোধে ব্যক্তিউদ্যোগের পাশাপাশি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর ভূমিকা রয়েছে। রোগী ও রোগীর আত্মীয়কে সঠিক তথ্য প্রদান করতে হবে। মনে রাখতে হবে- স্ট্রোক মানেই মৃত্যু নয়। সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলা এবং পুনরায় স্ট্রোকমুক্ত রাখা সম্ভব।
সূত্র: আমাদের সময়.কম