গত অর্থবছরের ( ২০২০-২১) জন্য সরকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট ঘোষণা করে। মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার রোধে কয়েক দফা লকডাউন পরিস্থিতিতে সরকার মাঝপথে এসে বাজেট সংশোধন করে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা গেছে, লক্ষ্যমাত্রার ৭৪ শতাংশ বা ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে সরকার। আর ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়নি, যা মোট বাজেটের ২৬ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বাস্তবায়নের এ হার সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। গত পাঁচ অর্থবছর ধরে বাজেটের ৮৪ থেকে প্রায় ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে। প্রতিবেদন বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, সরকারের ব্যয় কম হওয়ায় ঋণ কম হয়েছে। বাজেট ঘাটতিও হয়েছে কম। সরকার বৈদেশিক অনুদান পেয়েছে সামান্য। গত অর্থবছরে জিডিপির ২ শতাংশ বাজেট ঘাটতি হয়েছে। যদিও অনুদানসহ জিডিপির ৫ শতাংশ ঘাটতি প্রক্ষেপণ ছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্টি হওয়া পরিস্থিতি বাজেট বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা ছিল। তবে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে সক্ষমতা বাড়াতে পারলেও করোনার মধ্যেও এর চেয়ে বেশি হারে বাস্তবায়ন করা যেত। করোনার কারণে কিছু খাতে চাহিদা কমলেও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ব্যয়ের চাহিদা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এ সময়ে গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঠিক রাখতে স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডেও ব্যয়ের চাহিদা ছিল বেশি। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে এসব খাতে চাহিদা অনুযায়ী ব্যয় করা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন কম হওয়ার প্রধানতম কারণ করোনা। তবে করোনার বাইরেও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো এর জন্য দায়ী। এসব কারণের মধ্যে প্রকল্প পরিচালকদের কর্মস্থলে না থাকা অন্যতম। প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কোনো কাজ এগিয়ে নিতে হলে সশরীরে উপস্থিত থাকা জরুরি। কিন্তু কোনোভাবেই তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি বরাদ্দ করা অর্থ ছাড় নিয়েও সমস্যা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সময়মতো সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অর্থ ছাড় করলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়ের হাতে পৌঁছাতে যেসব ধাপ পেরোতে হয়, সেখানে বেশ সময় যায়। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি, জনবলের ঘাটতিও বাজেট বাস্তবায়ন কম হওয়ার কারণ।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই হিসাবের তাৎপর্য হলো ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি কর্মকাণ্ড অধিকতর ম্রিয়মাণ হয়েছে। ফলে পরিসংখ্যান ব্যুরো সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাথমিক হিসাব দিয়েছে, তা চূড়ান্ত হিসাবে কমে যেতে পারে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার প্রভাব বিবিএসের প্রাথমিক হিসাবে আসেনি। ফলে শেষ প্রান্তিকের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর সাম্প্রতিক সময়ের দুর্বলতম অর্থনীতির বছর হিসেবে প্রতিভাত হবে। তিনি বলেন, শুধু করোনার কারণে সরকারি ব্যয় এত কম হয়েছে, সেই যুক্তি পুরোপুরি সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, সরকার করোনা মোকাবিলার জন্য নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচিও ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সরকারের ব্যয় করার সক্ষমতার অভাব বাজেট বাস্তবায়নে অমোচনীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে পর্যবসিত হয়েছে। এ ছাড়া যেটুকু ব্যয় হয়েছে, তার ফলাফল জনগণ কতটুকু পাচ্ছে, তার কোনো মূল্যায়নের ব্যবস্থা না থাকায় বাজেটের গুণগত বাস্তবায়ন নিয়েও কোনো চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।
সুনির্দিষ্ট ও সময়নিষ্ঠ পরিকল্পনার অভাবে যে বাজেট বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়, তা সম্প্রতি অর্থ বিভাগের এক পর্যালোচনায়ও উঠে এসেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের বাজেট বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করে অর্থ বিভাগ দেখেছে যে, অর্থবছরের প্রথম ভাগে বাজেট বাস্তবায়ন চলে ধীরগতিতে। অর্থবছরের শুরুর দিকে বাজেটের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণেও ধীরগতি দেখা যায়। এ সময়ে বেতন-ভাতা ছাড়া প্রকল্পের অন্যান্য আইটেমের বিপরীতে ব্যয়ও কম হয়।
বিশেষ করে বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, মেরামত, সংরক্ষণ, নির্মাণ ও পূর্ত কাজ এবং মালামাল কেনা ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে অর্থবছরের শেষদিকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। উপরন্তু বছরের শেষে এসে সরকারকে অপরিকল্পিত ঋণের দায়ভার বহন করতে হয়। ফলে আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা যায় না।
উন্নয়ন ব্যয় : গত অর্থবছরে উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে অনেক কম। সরকার সংশোধিত বাজেটে ২ লাখ ৮ হাজার ২৫ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নেয়। অর্থবছর শেষে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ২৯ হাজার ৩২ কোটি টাকা, যা উন্নয়ন বরাদ্দের ৬২ শতাংশ। এর মধ্যে নিয়মিত ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। আর মূলধনী ব্যয় হয়েছে ৮৬ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। সরকারের উন্নয়ন ব্যয় কম হলে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়। বাজারে পণ্যের চাহিদা ও মুদ্রা সরবরাহ কমে যায়। যদিও গত অর্থবছরে কৃচ্ছ্রসাধন নীতির প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার ঠিক করে অর্থ ছাড় করে সরকার। যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি নয়, সেগুলোকে নিম্ন অগ্রাধিকারে রেখে অর্থছাড় কম করেছে সরকার।
রাজস্ব ও বৈদেশিক অনুদান সংগ্রহ : গত অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। গত অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া এনবিআরবহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। সবমিলিয়ে সরকার ৩ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের লক্ষ্যমাত্রার ৮৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ বা ২ লাখ ৬৯ হাজার ৭০২ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে। এনবিআর থেকে গত অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে। বাকি রাজস্ব এসেছে এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব থেকে। কর ব্যতীত রাজস্ব সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। এ খাত থেকে সরকার ৩৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করেছিল। অর্থবছর শেষে রাজস্ব এসেছে ৪৯ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।
বৈদেশিক অনুদান সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। গত অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৩ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। কিন্তু বছর শেষে তা পাওয়া গেছে মাত্র ৬৫ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান ছাড় হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে। প্রকল্পের নির্দিষ্ট অংশের সঙ্গে বৈদেশিক অনুদান নির্ধারিত থাকে। করোনার কারণে অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে বৈদেশিক অনুদানের ছাড় কম হয়েছে।
পরিচালন কর্মকাণ্ড : রাজস্ব সংগ্রহ যেমন কম হয়েছে, তেমনি সরকার পরিচালন ব্যয়ও কম করেছে। গত অর্থবছরের বাজেটে সরকার নিয়মিত খরচের জন্য ৩ লাখ ২ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে। অর্থবছর শেষে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ২৪৮ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি নেয়। গাড়ি কেনা ও বিদেশে প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখে। অন্যান্য কেনাকাটা, বিদেশ ভ্রমণ খাতে ব্যয় কমানো হয়। মূলধনী ব্যয়ও সরকার কম করেছে। বাজেটে লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার, ঋণ ইত্যাদি বাবদ ২৫ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা ব্যয় করার। বছর শেষে সেই ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৬৭ কোটি টাকা।
তবে সরকার খাদ্য হিসাবে বরাদ্দের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় করেছে। বাজেটে প্রথমে এ খাতে ৫৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে। করোনার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের কাজের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় সরকার খাদ্য সহায়তা ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বাড়ায়। কাজ হারিয়ে সংকটে পড়া কয়েক লাখ পরিবারকে বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করে সরকার। এ ছাড়া কম দামে খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) বাড়িয়ে দেয়। ফলে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ২ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা গেছে, এ খাতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ৪২২ কোটি টাকা।
খাতভিত্তিক পরিস্থিতি : সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য ২৫ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নেয় সরকার। গত অর্থবছরে হাসপাতাল উন্নয়ন, করোনার টিকাদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন, অক্সিজেন সরবরাহ উন্নয়ন, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ স্থাপন, চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের মতো বিভিন্ন কাজের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ১৫ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সম্ভব হয়নি।
তবে করোনার মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও এ খাতের বাজেট ব্যয় হয়েছে বেশ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের ৮৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের জন্য সংশোধিত বাজেটে ২৫ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। একইভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ তাদের ৩২ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দের ৯০ দশমিক ৪৮ শতাংশ ব্যয় করেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগের ব্যয় বেশ কম। এ মন্ত্রণালয় ৩৮ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বরাদ্দের ৬৫ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে। আর কৃষি মন্ত্রণালয় ১৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা বরাদ্দের ৮৯ দশমিক ৩১ শতাংশ ব্যয় করেছে।
সূত্র: সমকাল