মোবাইল ফোনে অর্থ লেনদেনের আলোচিত প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এর মালিকানা নিয়ে আইনগত জটিলতা দেখা দিয়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নগদের ৫১ শতাংশ মালিকানা ডাক বিভাগের হাতে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় আইনি জটিলতা নিরসনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে আগামী সপ্তাহে একটি বৈঠক করবে।
এদিকে, নগদ কর্তৃপক্ষ প্রায় ১৩ হাজার গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে এসব অ্যাকাউন্টের তথ্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দিয়েছে। নগদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে তারা এটা করেছেন এবং এখন তদন্ত করে অস্বাভাবিক লেনদেন নেই, এমন অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়া হচ্ছে।
নগদের ব্যবসা শুরু
নগদ তাদের অর্থ লেনদেনের কার্যক্রম চালানোর আড়াই বছর পর এসে এর মালিকানা এবং ব্যবসা পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডাক অধিদফতরের একটি চুক্তি করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অনুমতি নিয়েছিল ২০১৭ সালে। ওই চুক্তি অনুযায়ী বেসরকারি প্রতিষ্ঠাটির সাথে ডাক বিভাগের মুনাফা ভাগাভাগি হয়েছে। কিন্তু ডাক বিভাগের মালিকানা ছিল না।
ডাক বিভাগের ব্র্যান্ড ব্যবহার করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি নগদ নামে বাজারে লেনদেন শুরু করে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে।
মালিকানা ও নাম পরিবর্তন
গত বছর প্রতিষ্ঠানটিরই নাম পরিবর্তন করে থার্ড ওয়েভের পরিবর্তে নগদ করা হয়েছে। শুরুতে নগদের মালিকানায় যারা ছিলেন, তাদের অনেকে ছেড়ে দেয়ায় মালিকানায় আওয়ামী লীগের দুজন সংসদ সদস্য যুক্ত হন। তারা হলেন নাহিম রাজ্জাক এবং রাজী মোহাম্মদ ফখরুল।
এখন নগদের মোট নয়জন পরিচালক রয়েছেন। এরমধ্যে ছয়জন বাংলাদেশের নাগরিক। যুক্তরাজ্য, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের একজন করে নাগরিক আছেন।
মালিকানা নিয়ে জটিলতা কোথায়?
নগদকে সরকারের ডাক বিভাগের প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রচার করা হলেও এর কাগজপত্রে ডাক বিভাগের মালিকানা নেই বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এখন নগদের ৫১ শতাংশ মালিকানা ডাক অধিদপ্তরের কাছে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সরকার তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আইনগত জটিলতায় পড়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আফজাল হোসেন বলেছেন, সরকারের অধিদপ্তরের সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল অর্থ লেনদেনের এ ধরনের কার্যক্রমের নজির দেশে নেই।
সেজন্য প্রতিষ্ঠাটিকে কোম্পানি করার ক্ষেত্রে আইনগত সমস্যা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
‘আইনগত জটিলতা নিরসন করে আমরা এটাকে পূর্ণাঙ্গ কোম্পানি করতে চাইছি’, বলেন হোসেন।
সরকার ৫১ শতাংশ এবং থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস ৪৯ শতাংশ মালিকানা ভাগাভাগি করে ‘নগদ সার্ভিসেস পিএলসি’ নামের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করার কথা সরকার বলছে।
‘নগদের সাথে সরকারের চুক্তি কখনও প্রকাশ করা হয়নি’
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডাক বিভাগ সর্ম্পকিত আইনে নগদ তাদের কার্যক্রম চালানোর কথা বলেছে।
কিন্তু নগদ অর্থ লেনদেনের পাশাপাশি পেমেন্টের দায়িত্বও পালন করেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয় আপত্তি তুলেছে।
কোম্পানি আইনে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ফাউজিয়া করিম বলেন, সেবাদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান ডাক বিভাগের সাথে চুক্তি করে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসা করছে- এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে এ ধরনের চুক্তি যখন হয়, এগুলো সাধারণত প্রকাশ করা হয় না।
‘এসব ক্ষেত্রে কি ধরনের অংশীদারিত্ব থাকছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে, এ ব্যাপারে কোনো গেজেটও প্রকাশ করা হয়নি অথবা সংসদ বা অন্য কোনো ফোরামেও আলোচনা করা হয়নি- সে ব্যাপারে জনগণও সচেতন নয়। আমরাও আজকাল প্রশ্ন তুলি না’, বলেন ফাউজিয়া করিম।
ডাক বিভাগ শুধুই ব্র্যান্ড
কাগজপত্রে ডাক বিভাগের কোনো মালিকানা না থাকার অভিযোগ রয়েছে। তবে নগদের কার্যক্রমে ডাক বিভাগকে শুধু ব্র্যান্ড হিসাবে ব্যবহারের অভিযোগ মানতে রাজি নয় কর্তৃপক্ষ।
মোহাম্মদ আফজাল হোসেন বলেছেন, এত দিন মুনাফা ভাগাভাগি করা হতো। সেখানে ডাক বিভাগের ৫১ শতাংশ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি ৪৯ শতাংশ মুনাফার অংশীদার ছিল।
তিনি উল্লেখ করেন, এখন সরকার মালিকানার শেয়ার নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ কোম্পানি করছে।
মালিকানা নিয়ে নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদও একইরকম বক্তব্য দিয়েছেন।
নগদের ১৩ হাজার অ্যাকাউন্ট বন্ধ
মালিকানা প্রশ্নে নানা আলোচনার মাঝেই গত কয়েক দিন নগদের ১৩ হাজার গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে তাদের তথ্য সরকারের ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিট এবং পুলিশ-র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
যাদের নগদ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে, এমন অনেক গ্রাহক মঙ্গলবার ঢাকার রাস্তায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছেন।
তাদের একজন নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা রক্ষা করা হয়নি।
তবে নগদের তানভীর আহমেদ বলেছেন, অস্বাভাাবিক লেনদেনের কারণে তারা এমন ব্যবস্থা নেন।
তিনি যুক্তি দিতে গিয়ে আরো বলেছেন, ‘আমরা গত সপ্তাহে লক্ষ্য করেছিলাম যে দুটি ই-কমার্স সাইট থেকে অস্বাভাবিক রিফান্ড যাচ্ছে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে। ১২-১৩ হাজার অ্যাকাউন্টে আমরা এরকম পেয়েছি। এক দিনে হয়তো ৪০ বার রিফান্ড যাচ্ছে, যেটা অস্বাভাবিক।’
’আমরা সাময়িকভাবে এই অ্যাকাউন্টগুলো স্থগিত করে ফারদার তদন্তের আগে আমরা আসলে তথ্য ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে দিয়েছি। এগুলো সাথে সাথে ব্লক না করলে গ্রাহকের অর্থ নিয়ে একটা ঝুঁকি তৈরি হতো’ বলে দাবি করেন নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
তিনি অবশ্য বলেছেন, নিরাপরাধ বা নিরীহ গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট বাছাই করে সেগুলো তারা খুলে দিচ্ছেন।
‘প্রথমে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছি। এখন আমরা ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিটের সাথে তদন্ত করে অস্বাভাবিক লেনদেনে জড়িত নয়, এমন অ্যাকাউন্টগুলো খুলে দিচ্ছি’, বলেন আহমেদ।
এদিকে নগদের মালিকানা নিয়ে আইনগত জটিলতা নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে আলোচনার পর সর্বশেষ আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠকও করা হয়েছে।
এখন মন্ত্রণালয় আগামী সপ্তাহে বৈঠকে করে অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে চাইছে।
নগদের গ্রাহক প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি। দৈনিক নগদ-এর লেনদেন হচ্ছে ৭৫০কোটি টাকা।
সূত্র : বিবিসি