২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল পাকিস্তানকে ‘ন্যাটো বহির্ভূত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র’ হিসেবে অভিহিত করেন। এ ধরনের চরিত্র নিরুপণ আর্থিক বরাদ্দ দেয় এবং সামরিক পণ্য বিক্রিকে সহজ করে। সম্ভবত ইচ্ছাকৃত চিন্তাভাবনাই পাওয়েলকে অন্ধ করে দিয়েছিলো- তিনি ভেবেছিলেন পাকিস্তানের কূটনীতিবিদরা দক্ষ এবং পাকিস্তানের আরও গোপন কার্যক্রম ঢেকে রাখতে সক্ষম হবে তারা। অথবা এটি ছিলো পাকিস্তানের ব্লাকমেইল। এ ছাড়া ইরানের পোর্ট চাবাহার বন্দর ইস্যুর পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর মিশনে আফগানিস্তানের সমর্থন দেওয়া প্রয়োজন ছিলো। উল্লেখ্য, ভারত ও ইরানের ২০০৩ সালের চুক্তি অনুযায়ী বন্দরটি নির্মাণের দায়িত্ব পায় ভারত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আর কোন বিভ্রান্তির মধ্যে থাকা উচিত নয় যে বর্তমানে পাকিস্তান যেমন বিদ্যমান তেমনিভাবে কোন মিত্রকে এমন মর্যাদায় পৌঁছে দিতে হবে।
এদিকে তালেবানরা আফগানিস্তানের রাস্তার পাশে যেসব বোমা পুঁতে রেখেছিলো সেগুলোর বেশিরভাগই পাকিস্তানের দুটি রাসায়নিক কারখানা থেকে তৈরি হয়েছিলো। পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে অ্যাবদোবাদে আশ্রয় দিয়েছে। আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে বিদ্রোহের সময়ও তালেবানদের প্রতিটি জেষ্ঠ্য নেতা পাকিস্তানে বসবাস করেছে।
মূলত পচন শুরু হয় শীর্ষ থেকেই। আইএসআইয়ের প্রয়াত মহাপরিচালক হামিদ গুল অপ্রত্যাশিতভাবে তালেবানদের সেনাপতি হিসেবে কাজ করেছেন। তার উত্তরসূরীদের মধ্যে একজন আইএসআই প্রধান আসাদ দুরানি। ২০১০ সালে আমি যখন তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি তখন তালেবানদের প্রতি আইএসআইর সমর্থনের বিষয়ে আমি অপ্রস্তুত ছিলাম। পরবর্তীতে তিনি ৯/১১ হামলায় বিন লাদেনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। মাত্র ১৫ মাস আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বিন লাদেনকে ‘শহীদ’ হিসেবে অভিহিত করেন।
এর এক বছর পর পাকিস্তানের স্থানীয় গণমাধ্যম জিও’র ‘জিরগা’ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রাশেদ দম্ভ নিয়ে বলেছিলেন, কীভাবে পাকিস্তান মার্কিন সেনাবাহিনীকে বোকা বানিয়েছে। তালেবানরা দেশ দখলের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক পাকিস্তানি জেনারেল তা প্রকাশ্যে উদযাপন করেছিলেন। ইদানিং দেখা গিয়েছে তালেবানরা যখন সর্বশেষ প্রতিরোধ ঘাঁটি পাঞ্জশির উপত্যকা দখল করার চেষ্টা চালিয়েছে তখন তাদেরকে সহায়তা করতে প্রায় সময়ই পাকিস্তানি স্পেশাল ফোর্সগুলোকে গানশিপ ও ড্রোন নিয়ে উড়তে দেখা গিয়েছে। আইএসআই প্রধান ফায়েজ হামিদ তালেবান সরকার গঠনে সহয়তা করার জন্য যখন কাবুলে ছুটে গিয়েছিলেন তখন তা লুকানোর চেষ্টা করেননি। ১৯৭১ সাল পরবর্তী সময়ে মৌলবাদী ইসলাবাদীদের উৎসাহ এবং সন্ত্রাসী দলগুলোর প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন আইএসআই এবং এর বর্তমান কমানান্ডারদের অনুমোদন দেয়ার জন্য জন্য যথেষ্ট কারণ। আইএসআইকে অনুমোদন এবং তাদের প্রাপ্ত দুবৃত্ত লেবেল পাকিস্তানকে পুনরদ্ধারের ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা হতে পারে। এই আইএসআই দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তান সমাজকে জিম্মি করে রেখেছে।
এদিকে আইএসআইয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করার ইচ্ছার কারণে যুক্তরাষ্ট্রও একটি জটিল অবস্থায় পড়েছে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় পক্ষের শীর্ষ প্রতিনিধিরা মত দিয়েছেন যে আমেরিকান কূটনীতিকে ইসলামাবাদের মুখোমুখি করিয়ে বর্তমানের এই বিকৃত অবস্থা সৃষ্টি করেছে পেন্টাগন ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স। আর এটি সংশোধন করার জন্য তৎকালীন সিনেটর জন কেরি এবং রিচার্ড লুগার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উত্থাপিত একটি বিল সই করেন। যেখানে সামরিক বাণিজ্যকে ছাপিয়ে বেসামরিক সহায়তা ও উন্নয়নের উপর জোর দিয়ে নতুন পাকিস্তান কৌশল গ্রহন করা হয়। এই বিলের আওতায় উন্নয়ন এবং সামরিক বাহিনীর বেসামরিক তদারকির নিশ্চয়তার শর্ত দিয়ে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়।
কিন্তু এই পদক্ষেপটি পাল্টে গেল। এই অর্থ পাকিস্তানকে ‘খ্রিস্টান করা’ অথবা তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করার জন্য এই অর্থ দেয়া হয়েছে সামরিক বাহিনীর ছড়িয়ে দেয়া এমন মিথ্যা গুজবে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ত্বরিৎ প্রতিক্রিয়া জানায়। সম্ভবত প্রকৃত ভুলটিই ছিলো আইএসএর গলা টিপে না দিয়ে বেসামরিক সহায়তা করতে চাওয়া। পাকিস্তান বর্তমানে যে পথে চলছে তা অব্যাহত রাখলে ধ্বংস অনিবার্য। চীনের কাছে পাকিস্তান নিজেদের সার্বভৌমত্ব ইজারা দিলে তা স্বল্প সময়ের জন্য অনিবার্য হবে। দেশটি অবশ্যই ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কোন দেশই ধাক্কা সহ্য না করে রফতানির জন্য মৌলবাদী পন্থা গ্রহন করতে পারে না। পাকিস্তানের অর্থনীতির ক্ষতি এবং আইএসআইয়ের নীতির কারণে সুনামহানি দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আফগানিস্তান ভুল এই নাটকীয়তাকে আরো উসকে দেয়।
৯/১১ বিশতম বার্ষিকী আইএসআই প্রধান ফায়েজ হামিদ এবং বেঁচে থাকা তার পূর্বসূরীরিদেরকে সন্ত্রাসী ও আইএসআইকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেয়ার চমৎকার সুযোগ। প্রকৃতপক্ষে আইএসআইয়ের কার্যক্রমের রেকর্ড ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ড কর্প কুদস ফোর্সের মতোই রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্বক। আইএসআইয়ের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়াও এ সংগঠনটিকে নিরেপেক্ষ করতে নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থার দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সময় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। সূত্র : দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট্।
সূত্র: আমাদের সময়.কম