ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ক্যাপিটালে এফডিআর রেখে মেয়াদপূর্তির পরও টাকা ফেরত পাচ্ছে না যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেরী স্টোপস ক্লিনিক সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাত কোটি টাকা আটকে আছে। বিএটি বাংলাদেশের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ১০৯ কোটি টাকা আটকে রেখেছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। এই তহবিলের আটটি এফডিআরের মেয়াদপূর্তি হয় ২০১৯ ও ২০২০ সালে। নানা উপায়ে চেষ্টা করেও আমানত ফেরত নিতে পারছে না তারা। সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিতে ৩০০ কোটি টাকা রেখে আটকে গেছে আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি। বারবার তাগাদার পরও জমানো টাকা তুলতে পারছে না। আমানতকারীদের মধ্যে কিছু ব্যাংকও রয়েছে। অনুসন্ধানে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমন দৈন্যের তথ্য পাওয়া গেছে।
আর্থিক খাতের নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের একসময়কার নিয়ন্ত্রণে থাকা পিপলস লিজিং, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্সসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারার বিষয়টি সবার জানা। ২০১৪ সালে দখলের পর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে দুদক। এর বাইরে আরও কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান সময়মতো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। বিশেষ করে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কিংবা আরেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা আটকে যাওয়ায় আর্থিক খাতে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এতে করে ৮ থেকে ১২ শতাংশ সুদ অফার করার পরও সাধারণ আমানতকারীদের মতো করপোরেটগুলোও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে চাইছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে পদ্মা, আইসিবি ইসলামী, বাংলাদেশ কমার্স, বেসিকসহ কয়েকটি ব্যাংক সময়মতো আমানত ফেরত দিতে পারছে না।
সংশ্নিষ্টরা জানান, পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের অবস্থার অবনতি বেশ আগে থেকে হলেও এত খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগের পর। এর কিছুদিনের মধ্যে চার প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদারের টাকা তুলে নিয়ে পালানোর বিষয়টি সামনে আসে। এরপর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাধারণ আমানতকারীর মতো ব্যাংক এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর একযোগে টাকা তোলার চাপ তৈরি হয়। তখন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে তা জানাজানি হয়ে যায়। অধিকাংশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নতুন করে তহবিল জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট তহবিলের ৬০ শতাংশের মতো আসে ব্যাংক থেকে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের ক্ষেত্রে কাদের এসব প্রতিষ্ঠান দেওয়া হচ্ছে, তারা চালাতে পারবেন কিনা তা ভালোভাবে দেখা হয়নি। আবার অনুমোদনের পর এসব প্রতিষ্ঠান ঠিকভাবে তদারকি করা হয়নি। যে কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে আমানতকারী আর টাকা তুলতে পারছেন না। এটা খুব দুঃখজনক। দ্রুত এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিআইডি থেকে কাজ করে দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন প্রক্রিয়ার দুই বছর পার হলেও এখনও কোনো আমানতকারী টাকা ফেরত পাননি।
প্রতিষ্ঠানটিতে দুই হাজার ৩৬ কোটি টাকা আমানতের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ের আমানত রয়েছে সাড়ে সাতশ কোটি টাকা। পিপলস লিজিংয়ে জীবনের শেষ সম্বল জমা রেখে আর ফেরত পাচ্ছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনছুর আলী। তিনি জানান, বেশি মুনাফার আশায় পেনশনের টাকার একটি অংশ রেখেছিলেন পিপলস লিজিংয়ে। মুনাফা দূরে থাক, আসল টাকাও ফেরত পাননি। তার মতো অনেকেই এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন।
জানা গেছে, মেরী স্টোপস ক্লিনিক সোসাইটি ২০১৮ সালে ইউনিয়ন ক্যাপিটালে তিন মাস মেয়াদি দুটি আমানত রাখে। বেশ আগে থেকে এই অর্থ ফেরতের চেষ্টা করলেও ফেরত না দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগ দেখানো হচ্ছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর অভিযোগ করেছে তারা। বিএটি বাংলাদেশের শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে প্রথমে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ১০ কোটি টাকার একটি এফডিআর রাখা হয় ইউনিয়ন ক্যাপিটালে। ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আরও সাতটি এফডিআরের বিপরীতে ৬৭ কোটি টাকা রাখা হয়। সুদসহ সব মিলিয়ে পাওনা দাঁড়িয়েছে ১০৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট ইউনিয়ন ক্যাপিটালের চেয়ারম্যানের কাছে টাকা ফেরত চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
টাকা ফেরত না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তহবিল জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান একবারে টাকা তুলে নেওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। আবার তাদের ঋণের বেশির ভাগ দীর্ঘমেয়াদি। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের তহবিল সময়মতো ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ২০১৮ সালে আইসিবিতে তিন মাস মেয়াদি পাঁচশ কোটি টাকার আমানত রাখে। দীর্ঘদিনেও মূল টাকা ফেরত না পেয়ে বারবার নবায়ন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন চেষ্টার একপর্যায়ে ২০০ কোটি টাকা ফেরত পেলেও বাকি ৩০০ কোটি টাকা এখনও পায়নি। দ্রুত টাকা ফেরত চেয়ে গত ২৫ আগস্ট আবার চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। আইসিবিতে এক হাজার ৫০ কোটি টাকা আছে অগ্রণী ব্যাংকের। আসল টাকা ফেরত না পেয়ে বাধ্য হয়ে বছরের পর বছর পুনর্বিনিয়োগ করছে ব্যাংকটি। আইসিবিতে এ তহবিল রাখার শুরু ২০১৬ সালের মে মাসে।
শুধু যে আইসিবির কাছে অন্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের টাকা আটকে আছে, তা নয়। আইসিবিও অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে আর ফেরত পাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ১৪৫ কোটি, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ১১৮ কোটি ও প্রিমিয়ার লিজিংয়ে ৩৩ কোটি টাকা জমা রেখে তুলতে পারছে না। এর বাইরেও আরও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে আটকে গেছে। অর্থ আদায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আইসিবি। বিষয়টি জানার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর সম্প্রতি সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে আপাতত মামলা না করার অনুরোধ জানান। এর আগে একাধিক ব্যাংক টাকা তুলতে না পেরে মামলার উদ্যোগ নেয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকার্স সভায় মামলা না করে সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থ আদায়ের জন্য বলেছে।
জানতে চাইলে আইসিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা বিভাস সাহা বলেন, বিপিসির বাকি ৩০০ কোটি টাকা গত ৩১ আগস্ট মেয়াদোত্তীর্ণ হলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী মেয়াদে নবায়নের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আর অগ্রণী ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ২০ কোটি টাকার একটি মেয়াদি আমানত গত এপ্রিলে পরিশোধ করা হয়। বাকি এক হাজার ৫০ কোটি টাকা পরবর্তী ১২ মাসের জন্য নবায়ন করা হয়েছে। তিনি জানান, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে আইসিবির মেয়াদি আমানত নবায়ন করা হয়েছে। আর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও প্রিমিয়ার লিজিংয়ের টাকা নগদায়ন বিষয়ে গত ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, আইসিবির এমডি এবং সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এমডিদের নিয়ে ত্রিপক্ষীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে চলতি মাসের মধ্যে এ অর্থ নবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ফারইস্ট ফাইন্যান্সে অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমানে ৬০ কোটি টাকা রয়েছে। এর মধ্যে ছয় মাস মেয়াদে ১০ কোটি টাকা রাখা হয় ২০১৪ সালে। সর্বশেষ ২০২০ মালের মে মাসের পর আর মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। প্রতিষ্ঠানটিও টাকা ফেরত দেয়নি। একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ৫৬ কোটি ১৯ লাখ, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে ৫৬ কোটি ১৩ লাখ, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ৫০ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্স ও পিপলস লিজিংয়ে ৩৭ কোটি টাকা করে, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ৩৩ কোটি এবং বিআইএফসিতে রাখা ২০ কোটি টাকা ফেরত নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখা অন্যায় নয়। যদিও কতটুকু ঠিক, তা নিয়ে কথা উঠতে পারে। তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার ক্ষেত্রে এখন সব ব্যাংক অনেক সতর্কতা দেখাচ্ছে। জমানো টাকা ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করছে। একবারে এই চাপ তৈরি না হলে হয়তো এমন অবস্থা হতো না। এ সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক একটা পরিকল্পনা নিতে পারে।
জানা গেছে, কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে ফেরত পাচ্ছে না পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে পিডিবিএফের ২৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকার তিনটি এফডিআরের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে ২০১৯ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। প্রিমিয়ার লিজিংয়ে তিন কোটি ৬১ লাখ টাকার মেয়াদও পূর্ণ হয়েছে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। এর বাইরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে জমানো টাকার বিপরীতে সুদ পেলেও মূল টাকা তুলতে পারছে না তারা।
জানতে চাইলে পিডিবিএফের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অর্থ ও পরিকল্পনা মুহিউদ্দিন আহমদ পান্নু বলেন, এসব অর্থ রাখা হয়েছিল ২০১১-১২ সালের দিকে। দীর্ঘদিন ধরে টাকা ফেরত না পেয়ে তারা সমস্যায় আছেন। অর্থ উদ্ধারের জন্য পরিচালনা পর্ষদ থেকে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, টাকা ফেরত পাওয়া আমানতকারীর অধিকার। কোনো প্রতিষ্ঠান সময়মতো অর্থ ফেরত দিতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ এলে তা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সূত্র: সমকাল