একুশ বছরের টগবগে যুবক মোবারক হোসেন হৃদয়। দুই ভাই ও এক বোনসহ মা-বাবাকে নিয়ে তাদের ছোট সংসার। বাবা স্থানীয় গরিব মাছ ব্যবসায়ী।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর দক্ষিণ চরবংশী ইউপির পূর্বচরবংশী গ্রামে তাদের বসবাস। হাসিখুশি সংসার, ভালো চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক ঘটনায় বাজ পড়ে তার মাথায়। বন্ধুর ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে মিথ্যা মোটরসাইকেল চুরির মামলায় তার সব স্বপ্ন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। দেড় মাস কারাভোগ করার পর বাবার একমাত্র সম্বল অটোরিকশাটি বিক্রির টাকায় হৃদয় জামিন পান। মাথায় চুরির অপবাদ থাকায় কোথাও চাকরিও হচ্ছে না। তাই হৃদয় গত আট দিন ধরে এলাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
হৃদয় রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউপির ২০১৮ সালের ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন এবং বর্তমানে ৫নং ওয়ার্ডের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্ব চরবংশী গ্রামের গাজীবাড়ির আমজাদ গাজীর বড় ছেলে।
ছাত্রলীগ নেতা হৃদয় বলেন, চলতি বছরের ২৭ জুলাই সকালে একই এলাকার আবুল হোসেন কবিরাজের ছেলে বন্ধু সালমানের ডাকে সাড়া দিয়ে রায়পুর শহরের নতুনবাজার এলাকায় যাই। সে যে মাদক ব্যবসায়ী বা মোটরসাইকেল চোর তা আমার জানা ছিল না। সালমানকে তার বাবা কোনো এক অপরাধে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সালমান ২৬ জুলাই রাতে তার বন্ধু আনোয়ারের বাসায় ঘুমিয়েছিল।
তার ভগ্নীপতির কারণে বাসা থেকে মোটরসাইকেল বের করতে পারছিল না; এ কথা বলে মোটরসাইকেলটি বাসা থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে সালমানসহ আমি বাড়িতে চলে আসি। পরে ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি সালমান তার বন্ধু আনোয়ারের মোটরসাইকেলটি চুরি করিয়েছে আমাকে দিয়ে। এটি জানতে পেরে আমি তার দলের নেতাদের নিয়ে সালমানের বাড়িতে গিয়ে দেখি সে নেই, মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়েছে।
পরে ২৭ জুলাই পুলিশের হাতে সালমান ও হৃদয় আটক এবং ১ আগস্ট এ মামলায় তাদের আদালতে পাঠানো হয়। দেড় মাস কারাভোগ করে গত আট দিন আগে জামিন পাই আমি ও সালমান।
সরেজমিন মোল্লারহাট বাজারে রিকশাযাত্রী হয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। হৃদয় জানান, ২০১৫ সালে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
২০১৮ সালে দশম শ্রেণি লেখাপড়া অবস্থায় দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। বর্তমানে একই ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
দশম শ্রেণি পর্যন্ত মানবিক বিভাগে লেখাপড়া করা হৃদয় বলেন, তখনকার সময়ে আমাদের সংসারে অভাব-অনটনের মধ্যে ইউনিয়ন ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে হয়। যার কারণে এসএসসি পরীক্ষাটা পর্যন্ত দিতে পারিনি। পরে এ ঘটনায় জেল থেকে আসার পর ছোটখাটো চাকরির বা কাজের জন্য নেতাদের কাছে ঘুরেছি। কিন্তু সবাই চোর বলে বিতাড়িত করে দিয়েছে। তাই গত আট দিন ধরে নিজের এলাকায় অটোরিকশা চালাচ্ছি। স্থানীয়ভাবে পরিচিত হওয়ায় অনেকেই আমার রিকশায় উঠতে চান না বলে জানান হৃদয়।
স্থানীয়রা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং এখনও দায়িত্বে পালন করছেন হৃদয়। তার পরিবারের সদস্যরাও আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দল ক্ষমতায় থাকার পরও মিথ্যা চুরির ঘটনাটি তিনি বিচার পাননি। এখন তিন বেলার ভাত জোটানোই তার পরিবারের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হৃদয়ের রিকশায় চড়তে কেমন লাগে—এ প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় বাসিন্দা ফারুখ সর্দার, জহির হোসেন, মালেক উদ্দিনসহ অনেকেই বলেন, হৃদয় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার বাবাও আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিত। কিন্তু ছেলেটিকে মিথ্যা মোটরসাইকেল চুরির মামলায় ফাঁসিয়ে সর্বস্বান্ত করেছে। কোথাও বিচার পাচ্ছে না। এখন সে লেখাপড়া ছেড়ে ভাড়ায় রিকশা চালায়। এখন তার রিকশায় যাত্রী হতে লজ্জা লাগে।
রায়পুর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক পাপেল মাহমুদ বলেন, হৃদয় আগে ছাত্রলীগ করত, এখন করে না। মিথ্যা চুরির মামলার বিচার পায় না; এটি দুঃখজনক। জীবিকার জন্য হৃদয় রিকশা চালাচ্ছেন; এতে লজ্জার কিছু নেই। তবে অনেকেই এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছেন। দেখি তার জন্য কিছু করতে পারি কিনা।
রায়পুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইসমাইল খোকন বলেন, হৃদয় দুঃসময়ে দলের জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে জেল খেটেছেন; তা তো জানি না। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র: যুগান্তর