ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত-২০১৯)-এর ৪ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া কোনো ইটভাটা চালানো যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে দুই বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়াও ইটভাটা নির্মাণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিএসটিআই, স্থানীয় ভূমি অফিসসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থার ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। কাগজে-কলমে এমন নিয়ম থাকলেও তা মানতে নারাজ চট্টগ্রামের অসাধু তিন শতাধিক ইটভাটা মালিক। প্রশাসনের কঠোরতার অভাবকে পুঁজি করে ‘অবৈধ’ তিন শতাধিক ইটভাটা চলছে বছরের পর বছর। এদের কারও নেই ছাড়পত্র; কেউ মানছেন না আইনও। সুস্থ পরিবেশের জন্য এসব ইটভাটা এখন ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিযান চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও কিছুদিনের মধ্যে আবারও চালু হতে যাচ্ছে অনেক ইটভাটা। ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের আদেশ বারবার থাকছে উপক্ষিত। কড়া হুঁশিয়ারি, জরিমানা ও মামলা করেও এসব ইটভাটা বন্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন। অসাধুরা অবৈধ ইটভাটা চালু করতে অবলম্বন করছে উচ্চ আদালত থেকে স্টে অর্ডার নেওয়ার অপকৌশলও। স্থানীয় অনেক জনপ্রতিনিধি অবৈধ ইটভাটার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি পরিবেশ অধিদপ্তরের। উচ্চ আদালতের উচ্ছেদ আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এরই মধ্যে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ওপর আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন চেম্বার জজ আদালত।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে তিনশর বেশি ইটভাটা অবৈধভাবে ব্যবসা করে আসছে। বাস্তবে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা আরও বেশি। অনেক প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হলেও করেনি নবায়ন। অনুমতিপত্র নিতে বললেও তাও মানছে না তারা। সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে রাঙ্গুনিয়ায় ৬৯টি। ফটিকছড়িতে ৪৬টি, হাটহাজারীতে ৪০টি, সাতকানিয়ায় ৩৮টি, রাউজানে ৩৬টি ও চন্দনাইশে ৩২টি।
রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর গাবতল এলাকায় কয়েক বিঘা ফসলি জমি নষ্ট করে ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে মাটি। সরেজমিন দেখা গেছে, এতে হুমকির মুখে পড়েছে ফসলি জমিসহ সড়ক ও বসতবাড়ি। ইসলামপুরের মাজার গেট এলাকায় প্রায় আধাকিলোমিটার জায়গায় অন্তত সাতটি ইটভাটা থেকে উৎপাদিত ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া দূষণ করছে চারপাশের সবুজ পরিবেশ। বিশাল কৃষিজমি আর সবুজ প্রকৃতির সমারোহের ঠিক মাঝখানেই খোলা চিমনির ইটভাটা কাঠ ও পাহাড়ের মাঠি পুড়িয়ে সৃষ্টি করছে কালো ধোঁয়া। সাতকানিয়ার কেরানিহাট এলাকায় একই সারিতে তিনটি ইটভাটা দেখা গেছে। ইছানগর, চরলক্ষ্যা, ডাঙ্গাচর, কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন পাড়ে প্রধান সড়ক ও বসতির পাশেই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি ইটভাটা পরিবেশ দূষণ করছে। অথচ ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইনের ৮ ধারায় কৃষিজমি, অভয়ারণ্য, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা, জনবসতি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন সদরের এক কিলোমিটার এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দুই কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে।
শহরের পাশাপাশি গ্রামেও নানা অবকাঠামো তৈরির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি লাভের আশায় অবৈধ ইটভাটা ব্যবসায় ঝুঁকছে এক শ্রেণির মানুষ।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান সমকালকে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়নে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে অনেক অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু ইটভাটা ফের চালু হওয়ার তথ্যও পেয়েছি। সেগুলোসহ সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মনজুরুল হুদা সমকালকে বলেন, লাভজনক হওয়ায় কৃষিজমি ও পরিবেশের ক্ষতি জেনেও বেশিরভাগ ইটভাটা কৃষিজমির পাশেই অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশের বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।
উচ্চ আদালতে রিটকারী আইনজীবী হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, আদালত অবৈধভাবে পরিচালিত সব ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নে প্রশাসন এখনও সফল হয়নি। প্রশাসনের নিষ্ফ্ক্রিয়তায় কয়েকশ ইটভাটা সম্পূর্ণ অবৈধভাবেই চলছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী বলেন, পরিবেশ দূষণের জন্য অবৈধভাবে পরিচালিত ইটভাটাগুলো বেশিরভাগ দায়ী। ইটভাটার কালো ধোঁয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সব অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। অধিদপ্তরের উপপরিচালক (জেলা) জমির উদ্দিন বলেন, নিয়মনীতি না মেনেই দীর্ঘদিন ধরে তিন শতাধিক অবৈধ ইটভাটা পরিচালিত হয়ে আসছে। এদের ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। অভিযান চালিয়ে এরই মধ্যে শতাধিক ইটভাটা বন্ধ করেছি।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ইটভাটার ধোঁয়া শিশু ও বয়স্কদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। এ থেকে শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কিউলাইটিস, চর্মরোগ ও ফুসফুসের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কম দূরত্বের মধ্যে একাধিক ইটভাটা থাকলে তা জনস্বাস্থ্যের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। চট্টগ্রাম, বিএম ও এসবি ব্রিকস, শাহজালালসহ বেশ কয়েকটি ইটভাটা বন্ধ করার পর আবারও চালুর প্রমাণ পেয়েছে প্রশাসন।
সূত্র: সমকাল