দেড় বছর পর স্কুল-কলেজ খুলেছে। খোলার অপেক্ষায় আছে বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ২৮ শিক্ষার্থী এবং ১১ জন শিক্ষক। এ ছাড়া উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে এক শিক্ষার্থী। এমন পরিস্থিতিতে করোনা উপসর্গ থাকলে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে না পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে উপমন্ত্রী দাবি করেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো তথ্য মেলেনি। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, করোনার সংক্রমণ এখন নিম্নমুখী। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার চিন্তাভাবনাও চলছে। তবে জোন বা উপজেলাভিত্তিক সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সামনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সংক্রমণ বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে এখনও আশঙ্কা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সমস্যাটি প্রকট হবে না বলে আশা করছেন তারা। দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় গত ১২ সেপ্টেম্বর খোলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত বুধবার রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মানিকগঞ্জ এসকে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী সুবর্ণা ইসলাম রোদেলা। এর আগে ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী করোনা পজিটিভ হওয়ায় ওই শ্রেণির পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে ৫৮ সহপাঠীর করোনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ আসায় পাঠদান ফের চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জানা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়েই আছে ১৩ শিক্ষার্থী।
তাদের পাঁচজন সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউপির বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। তাদের মধ্যে তিনজন পঞ্চম শ্রেণির ও দু’জন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রথমে এই স্কুলের তিন শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত হয়। পরে তাদের সংস্পর্শে আসা কয়েক শিক্ষার্থীর নমুনা পরীক্ষা করালে একই স্কুলের দু’জন ছাড়াও হাজিপাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঁচজন ও সোনালী শৈশব বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর করোনা ধরা পড়ে। পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে দুই সপ্তাহের জন্য এসব স্কুলে পাঠদান বন্ধ করা হয়। এ ছাড়া চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার হাসিমপুরের ড. মনসুর উদ্দীন মহিলা কলেজের তিন শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ মো. শহীদুল ইসলাম জানিয়েছেন, করোনা শনাক্ত শিক্ষার্থীদের হোম আইসোলেশন নিশ্চিত করা হয়েছে।
গোপালগঞ্জের দুই স্কুলে দুই শিক্ষার্থীর আক্রান্তের খবর মিলেছে। গোপালগঞ্জ পৌরসভার ১০২নং বীণাপাণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোনালিসা ইসলামের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এখন বন্ধ রয়েছে ওই শ্রেণির পাঠদান। এই জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার ৪ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী তিনা খানম আক্রান্ত হয়েছে করোনায়। এই বাইরে, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০ শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের সবাই মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার্থী। তাদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। বর্তমানে সবাই সুস্থ রয়েছেন বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। আক্রান্ত স্কুলশিক্ষকদের মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়েই আছেন ছয়জন। জেলা শিক্ষা অফিস জানিয়েছে, সংক্রমিত শিক্ষকদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও করোনা আক্রান্ত হয়েছেন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার চিড়াভেজা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুশান্ত কুমার রায়। আরও আক্রান্ত হয়েছেন একই স্কুলের শিক্ষক রমিজুল ইসলাম ও আব্দুল জলিল। গত ২১ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা করিয়ে পরদিন করোনা পজেটিভ আসে তাদের। বাগেরহাট জেলার মোংলা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক স্ত্রীসহ আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এর বাইরে নোয়াখালী সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে পূর্বচরভাটা রেড ক্রিসেন্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আরও একজন করোনা উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে আছেন। এ অবস্থায় স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধের উপক্রম হওয়ায় পাশের হাবিবিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে সাময়িকভাবে দায়িত্ব দিয়েছে উপজেলা শিক্ষা অফিস। এই ঘটনার পর থেকে গ্রামের স্কুলগুলোতে কমে গেছে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি। শিক্ষার্থী আক্রান্তের বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষার্থীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে স্কুলে আসার পর কোনো ছাত্রছাত্রীর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণ শিক্ষার্থীরা ঘরে থাকলে হতো না বা স্কুলে যাওয়ার কারণে হয়েছে- এটার কোনো সত্যতা বা প্রমাণ এখন পর্যন্ত নেই। শিক্ষার্থীরা স্কুলে না গেলেও আত্মীয়স্বজনের বাসায়, বিনোদনের জায়গাসহ সব খানেই যাচ্ছিল। সুনির্দিষ্ট কিছু জায়গায় দেখেছি, শিক্ষার্থীরা করোনা আক্রান্ত হয়েছে। আমরা সেখানে ব্যবস্থা নিয়েছি। করোনার উপসর্গ থাকলে শিক্ষার্থীদের স্কুলে না পাঠাতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেছেন, আমাদের সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আমরা অভিভাবকদের বলেছি, কোনো শিক্ষার্থীর বিন্দু পরিমাণ উপসর্গও যদি থাকে বা তার বাড়িতে কারও উপসর্গ থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীকে স্কুলে পাঠানো যাবে না। গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের বাড়িতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসার পথে করোনা সংক্রমণ হতে পারে। আমরা এ বিষয়ে সতর্ক আছি। ডা. দীপু মনি বলেন, শিক্ষার্থীর ক্লাসে উপস্থিতি নিয়ে চাপ দেওয়া যাবে না। দেখতে হবে, সে কেন উপস্থিত হলো না। কিন্তু কোনোভাবেই জোর করা যাবে না। কারণ কোনো শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণ না করতে পারলেও তার জন্য অনলাইন ও টিভিতে এখনও ক্লাস চালু আছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসাইন গতকাল বলেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কভিড প্রতিরোধ কমিটি আছে। এগুলোকে কার্যকর করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন, ইউএনও, জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে পরামর্শ করতে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের বলা হয়েছে। আতঙ্কিত নয়, সতর্ক হওয়ার পরামর্শ: শিক্ষার্থীদের আক্রান্ত হওয়া নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকাকরণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে যে এলাকার স্কুলগুলোতে আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে, সে এলাকাগুলো নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ের গড় সংক্রমণকে মাথায় রেখে স্কুলগুলো খোলা হয়েছে। সে জায়গা থেকে বলতে হবে, ঝুঁকি নেই। তবে সংক্রমণের মূল্যায়ন করতে হবে উপজেলা বা ওয়ার্ডভিত্তিক। উপজেলার সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে সংক্রমণ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ এখনও সেখানে কমিউনিটি সংক্রমণ রয়ে গেছে। না হলে বাচ্চারা আক্রান্ত হতো না। তাই আমাদের পরিকল্পনার ধরনটি পাল্টানোর প্রয়োজন আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকদের শতভাগ টিকার আওতায় নিয়ে আসাটা জরুরি। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সহযোগিতা করতে হবে। অনেক অভিভাবকই স্কুলের সামনে ভিড় করেন, তারা যদি সঠিকভাবে মাস্ক পরেন, তাহলে তা সবার জন্যই ভালো হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারকে বলেছি, শিশুদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফাইজারের টিকা দিতে হবে। সরকারও আমাদের পরামর্শের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।’ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম আরও বলেন, মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফেরার সময়ে শিক্ষার্থীরা করোনা আক্রান্ত হচ্ছে বলে ধারণা করছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমরা একটি লিখিত নির্দেশনা পাঠিয়েছি। আক্রান্ত হলে পরে কী করতে হবে, সে বিষয়েও নির্দেশনা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া আছে। এ ছাড়া আইইডিসিআর কাজ করছে, তারা আক্রান্ত হওয়ার কারণগুলো খতিয়ে দেখছে। তিনি আরও বলেন, সারা পৃথিবীতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে, সংক্রমণ বাড়লে বন্ধ করেছে, পরে আবার খুলেছে। সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। সেটাতে সমস্যা হলে মোকাবিলা করতে হবে। সংক্রমণ বেড়ে গেলে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিতে হতে পারে। তবে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক হারে সংক্রমণের কোনো তথ্য নেই। এখন পর্যন্ত আমরা আশঙ্কাজনক কিছু দেখছি না।
সূত্র: সমকাল