সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা। চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার কল্পলোক আবাসিক এলাকার ‘এফ’ ব্লক। আবাসিক এলাকার লোকজন অফিসে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে স্কুল-কলেজে। এ সময় ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যভর্তি একটি মিনি ট্রাক এসে থামল ৫২৭ নম্বর ভবনের (আল মারওয়া টাওয়ার) সামনে। সঙ্গে সঙ্গে ভবনের প্রধান ফটক খুলে দেওয়া হলো। ফটক খুলতেই শ্রমিকরা ট্রাকে থাকা সয়াবিন তেলের বড় বড় কার্টন, ডাল, চিনি ও চা পাতার কার্টন নামাতে শুরু করে। শতাধিক কার্টন নামানোর পর ট্রাকটি চলে যায়।
জানা যায়, যে ভবনে পণ্য নামানো হয়েছে, সেই ভবনে টিসিবির কোনো ডিলার থাকেন না। ডিলারের কোনো গুদামও নেই। আবুল হাশেম নামে এক ব্যক্তির কাছে এই পণ্য বিক্রি করেছেন টিসিবির এক ডিলার। হাশেম সেই পণ্য আবার খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন। এভাবেই টিসিবির পণ্য কালোবাজারে বিক্রি করছে চট্টগ্রামে টিসিবির অসাধু কিছু ডিলার।
র্যাবের কাছে তথ্য ছিল টিসিবির পণ্য কালোবাজারে এভাবে বিক্রি করার। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ওই ভবনে অভিযান চালিয়ে র্যাব আবুল হাশেমকে আটক করেছে। তার বাসা থেকে উদ্ধার করে টিসিবির বেশকিছু পণ্যও।
চট্টগ্রামে বেশকিছু অসাধু ডিলার ন্যায্যমূল্যের সরকারি পণ্য কালোবাজারে বিক্রি করছে-এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। টিসিবির ও ডিলারদের একটি সূত্র নিশ্চিত করে, সোমবার ভোরে বাকলিয়া থানার কল্পলোক আবাসিক এলাকার একটি ভবনে টিসিবির পণ্য নামবে। গোপনে এ সংবাদ পাওয়ার পর প্রতিবেদক সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ওই ভবনের সামনে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ পরই সেখানে টিসিবির পণ্য নিয়ে একটি ট্রাক এসে থামে। ট্রাকের ওপর দুজন শ্রমিক ছিলেন। দুজন মধ্যবয়সি লোক ছিলেন ট্রাকের চালকের পাশে। শ্রমিকরা ট্রাক থেকে টিসিবির পণ্যগুলো তাড়াহুড়া করে নামিয়ে দেন। এরপর কিছু পণ্য মাহিন্দ্রা গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আনোয়ারা উপজেলার দিকে।
ট্রাক নম্বর নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সোমবার চট্টমেট্রো-ন ১১-০৬৭১ ট্রাক দিয়ে টিসিবির পণ্য উত্তোলন করেছে ‘স্বচ্ছ ট্রেডিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মালিক দোলন নামে একজন। আল মারওয়া ভবনের দারোয়ান এখলাছ জানান, হাশেমের বাসা ওই ভবনের পঞ্চমতলায়। ২-৩ মাস ধরে তিনি টিসিবির পণ্য এনে জমা করে রাখতেন। দুপুরে কল্পলোকের আল মারওয়া ভবনে অভিযান চালায় র্যাব-৭ এর একটি টিম। তখন আবুল হাশেমকে আটক করেন র্যাব কর্মকর্তারা। এ সময় বেশকিছু টিসিবির পণ্যও জব্দ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, টিসিবি চট্টগ্রামের কতিপয় কর্মকর্তার কাছে অনিয়মই নিয়ম। তারা ডিলারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়ে ন্যায্যমূল্যের মালামাল বাইরে বিক্রি করে দেন। টিসিবির ডিলার নিয়োগ গাইডলাইনে ডিলারশিপ বাতিলের ১৬টি কারণ চিহ্নিত করে দেওয়া আছে। এর মধ্যে ৫ নম্বর শর্তটি হলো বরাদ্দকৃত পণ্য বিক্রিতে অনিয়ম, ওজন বা মূল্যে কারচুপি করলে অথবা পণ্য কালোবাজারে বিক্রি করলে ডিলারশিপ বাতিল এবং জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। এরপরও প্রায়ই পণ্য কালোবাজারে বিক্রি হলেও ডিলারদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। টিসিবির কর্মকর্তারা জানান, টিসিবি ক্রেতাদের মাঝে প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকা, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১০০, প্রতি কেজি মসুর ডাল (তুরস্কের) ৫৫ এবং প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০ টাকায় বিক্রি করছে। এসব পণ্যের মূল্য বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম। সূত্র জানায়, প্রতিদিন প্রতি ট্রাকে ৫শ কেজি চিনি, ১ হাজার লিটার সয়াবিন তেল, ৪শ কেজি মসুর ডাল, ৭শ কেজি পেঁয়াজ দেওয়া হয়। পণ্যের মানও ভালো। প্রতিদিনই প্রতিটি ট্রাকের সব পণ্য বিক্রি হয়ে যায়। সরবরাহ দিয়ে কুলাতে পারছে না সেল ট্রাকগুলো। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে তেল ও পেঁয়াজ। কম দামের এই পণ্য একশ্রেণির অসাধু ডিলার অতি মুনাফার লোভে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে।
টিসিবির চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যনির্বাহী জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনো ডিলার অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে কোনো ছাড় নেই।
সূত্র: যুগান্তর