ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভেতরে জটিলতা তৈরি হয়েছে। ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি বা এর আগে যাদের জন্ম তাদের তথ্য কোনো পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হবে-তা নিয়ে মাঠপর্যায়ের ও ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে দুই মত তৈরি হয়েছে। ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের প্রস্তাব করেছেন।
অন্যদিকে ইসি সচিবালয় ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের তথ্য এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়াদের ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের প্রস্তাব করেছে। এ পদ্ধতি কতটা কার্যকর তা দেখার জন্য পাইলট প্রোগ্রাম নেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে। ভিন্ন মতের কারণে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম পদ্ধতি চূড়ান্ত করা নিয়ে বিপাকে পড়েছে ইসি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
আইন অনুযায়ী প্রতি বছরের ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের নিয়ম রয়েছে। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ ও তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছিল ইসি। তাদের মধ্যে যারা যোগ্য হয়েছেন তাদের ভোটার তালিকাভুক্ত করা ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া হয়।
নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ুন কবীর বলেন, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রস্তাব ‘জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ কমিটি’তে জানানো হয়েছে। ওই কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও একটি মতামত আমাদের দিয়েছেন। সার্বিক বিষয়গুলো আমরা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক কমিটিতে পাঠাব। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী পুরো বিষয়টি কমিশনে তুলবেন। তবে প্রস্তাবে কী আছে তা স্পষ্ট করেননি তিনি।
জানা গেছে, ২৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের ৮৪তম সভায় ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি বা এর আগে যাদের জন্ম তাদের তথ্য সংগ্রহে কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। ওই প্রস্তাবে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে অনলাইনে আবেদন ও নির্বাচনি অফিসে তথ্য নিবন্ধনের কথা বলা হয়। তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ কমিটি পাঠানো হয়।
আরও জানা গেছে, ২৫ আগস্ট থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ কমিটির দুটি এবং ‘২০০৬ বা তার আগে জন্ম গ্রহণকারী নাগরিকদের এনআইডি নিবন্ধন সম্ভাব্যতা যাচাই উপ-কমিটির তিনটি কমিটির বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়ে দুই ধরনের মতামত উঠে আসে।
‘জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ কমিটির এক বৈঠকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থী ও ঝরে পড়াদের তথ্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংগ্রহের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। এ কমিটির আরেক বৈঠকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম কতটা কার্যকর হয় তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাইলট কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশন, শহর ও গ্রাম পর্যায়ে আলাদা পাইলট প্রোগ্রাম করতে বলা হয়।
এর আগে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে এনআইডি নিবন্ধন সম্ভাব্যতা যাচাই উপ-কমিটির সদস্যরা তিন দফায় বৈঠক করেন। যদিও তিনি কাছে ওইসব বৈঠকে সভাপতিত্ব করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। কিন্তু বৈঠকের কার্যবিবরণীতে সভাপতি হিসাবে তিনিই স্বাক্ষর করেছেন।
তিন দফা বৈঠকের প্রথমটিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ না করে বিকল্প হিসাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগ্রহের বিষয়ে আলোচনার জন্য তোলা হয়। এতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের তথ্য ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে নেওয়ার বিষয়টিও ওঠে। ওই সভায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত নিয়ে এ বিষয়টি চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে। ওই সভায় প্রথাগতভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের সুপারিশ করেন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা।
এ সুপারিশের পক্ষে তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া রোধ এবং মৃত ব্যক্তিদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের বিকল্প নেই। দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের কারণ দেখিয়ে জানুয়ারিতে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা হয়। তৃতীয় সভায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবং স্কুল থেকে- এ দুই পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের কথা বলা হয়।
ইসির সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। এ কারণে গত দুই বছরে মারা যাওয়া ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। ২০১৯ সালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করায় ১৩ লাখ ৯২ হাজার ২৩৬ জন মৃত ভোটারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। শনাক্ত করা হয় ২ লাখ ৭ হাজার ৬৩৫ জন দ্বৈত ভোটার।
সূত্র: যুগান্তর