ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ধীরে তদন্ত চলছে। মামলা নিষ্পত্তির কার্যক্রমেও গতি নেই। ফলে জড়িতদের কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। জালিয়াতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় নতুন করে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে।
সূত্র জানায়, জুন পর্যন্ত ঋণ জালিয়াতির বিভিন্ন ঘটনায় ১৩৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রায় হয়েছে ৯টি মামলার। এগুলোতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ ব্যবসায়ীদের জেল হয়েছে। বাকি মামলা বিচারাধীন।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত করে দ্রুত মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নয়টি গ্রুপ, দুটি ব্যাংক ও এক ব্যক্তির নামে ৩১ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।
এর মধ্যে রয়েছে হলমার্ক গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, অ্যানন টেক্স গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, সিটিসেল, সানমুন গ্রুপ, নুরজাহান গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ এবং পিকে হালদার। এছাড়াও ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে দুটি। এর মধ্যে রয়েছে বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক।
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, মামলায় বিচার ত্বরান্বিত করতে সার্বিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুদকের আইনজীবীদের মামলার সব তথ্য আইনানুগভাবে আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
কমিশনও চায় দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। নতুন দুর্নীতি বন্ধ হোক। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হলে আদালতের সময় বাঁচবে, বিচারপ্রার্থীদের হয়রানিও কমবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকেও বিভিন্ন ঋণ জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করে দুদকে প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে। দুদক সেগুলোর আলাদা আলাদা ঘটনা পুনরায় অনুসন্ধান করে মামলা করছে। এছাড়া সিআইডিও দুর্নীতির বিভিন্ন ঘটনা তদন্ত করছে।
বিভিন্ন সংস্থার দায়ের করা ঋণ জালিয়াতির মামলায় এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের ১২৫ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নন-ব্যাংকিংসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের অনেকে এখন জেলে রয়েছেন। কেউ কেউ জামিনে বের হয়েছেন।
ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩৫টি মানি লন্ডারিং মামলার অনুসন্ধান করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে ৩৫টির কাজ শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। নিম্ন আদালত থেকে রায় হয়েছে ৯টি মামলার। বাকিগুলো বিচারাধীন।
এসবের মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার সাক্ষীর জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। করোনার কারণে গত দুই বছর ধরে মামলার শুনানি ও তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে মামলার নিষ্পত্তি কম হচ্ছে। এছাড়া অনেক সময় সাক্ষী আদালতে আসছেন না, বিচারক থাকছেন না। কাজেই মামলার নিষ্পত্তি কম।
জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অনেক মামলায়ই আসামিরা সাজা পেয়েছেন। দুদকের মামলা সাধারণত ডকুমেন্টভিত্তিক হয়ে থাকে।
তাই ডকুমেন্ট যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমেই আসামিদের সাজা নিশ্চিত করা হয়। সূত্র জানায়, হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকসহ ২৬টি ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। টাকা আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে ব্যাংক।
সেগুলো বিচারাধীন। এদিকে জালিয়াতির ঘটনায় অনুসন্ধান করে ২০১৩ সালে ৪০টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে ফান্ডেড বা সরাসরি ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ৩৮টি এবং নন-ফান্ডেড বা পরোক্ষ ঋণের জন্য ২টি। জালিয়াতির মধ্যে ফান্ডেড প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
নন-ফান্ডেড ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা অন্যান্য খাতে। ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দেয় সংস্থাটি। এগুলোতে হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, তানভীরের আত্মীয় ও গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ এবং সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে দায়ী ৩৫ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে। প্রায় ৮ বছরে ৪০টি মামলার মধ্যে নিম্ন আদালতে রায় হয়েছে মাত্র একটি মামলার। এতে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এর মধ্যে রয়েছেন-হলমার্ক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান প্যারাগন নিট কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম রাজা, পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ও সোনালী ব্যাংকের হোটেল রূপসী বাংলার কর্মকর্তা সাইফুল হাসান।
বাকি মামলাগুলো এখন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় প্রায় হাজারের বেশি সাক্ষী রয়েছে। মামলার শুনানির দিন সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না বলে বিচারকার্য বিলম্বিত হচ্ছে। তবে বেশ কয়েকটি মামলা রায়ের পর্যায়ে রয়েছে।
এগুলোতে হলমার্কের চেয়ারম্যান, এমডি ও জিএমসহ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ূন কবীরসহ অনেকে পলাতক। হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামের বিরুদ্ধে করা একটি মামলায় তিন বছরের জেল হয়েছে।
হলমার্ক গ্রুপের নন-ফান্ডেড ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে দুদক। নন-ফান্ডেড অংশের ২টি মামলা হয়েছে ২০১৩ সালে। এগুলো বিচারাধীন। তদন্ত শেষ হলে আরও মামলা হবে বলে জানা গেছে। তবে তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
বিসমিল্লাহ গ্রুপ ২০১৩ সালে ৫টি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পুরো অর্থই বিদেশে পাচার করে। এসব ঘটনায় দুদক ১২টি মামলা করেছে। এতে ৫৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ জনই ব্যাংক কর্মকর্তা।
আর বাকি ১৩ জন বিসমিল্লাহ গ্রুপের কর্মকর্তা। সবকটি মামলার আসামি হয়েছেন গ্রুপের এমডি খাজা সোলেমান চৌধুরী। এর মধ্যে একটির রায় হয়েছে। এতে গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরিন হাসিব, ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলেমান চৌধুরীসহ ৯ জনের ১০ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে।
একই সঙ্গে দ্বিগুণ অর্থ জরিমানা করা হয়েছে। এর পরিমাণ ৩০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। বাকি মামলাগুলো বিচারাধীন।
সরকারি একটি ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি করেছে। এছাড়াও তাদের সরকারি বিকল্প নগদ সহায়তাসহ পরোক্ষ ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রুপের কর্ণধার এমএ কাদেরসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা করে দুদক।
এর মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা রয়েছেন ১৫ জন ও ৭ জন গ্রুপের কর্মকর্তা। এগুলো বিচারাধীন রয়েছে। বাকি অর্থের ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে।
অ্যানন টেক্স গ্রুপের নামে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে দুদক তদন্ত করছে।
এসএ গ্রুপ ১৬টি ব্যাংক থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করেছে। এর দায়ে গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংক ও দুদক ১৪টি মামলা করেছে। চেক জালিয়াতির দায়ে মামলা করেছে ন্যাশনাল ব্যাংক।
ঋণ জালিয়াতির দায়ে সাউথইস্ট ও ন্যাশনাল ব্যাংক মিলে আরও ব্যাংক ৫টি মামলা করেছে। ব্যাংক এশিয়ার একটি মামলায় এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলমকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। পরে তিনি জামিনে বের হয়েছেন। ওইসব মামলা এখন বিচারাধীন রয়েছে।
এবি ব্যাংকের গ্যারান্টিতে বেসরকারি খাতের ১২টি ব্যাংক থেকে সিটিসেল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি। এর মধ্যে একটি ঘটনায় ২০১৭ সালে ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এটি বিচারাধীন রয়েছে।
সানমুন গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৬ সালে গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে দুদক একটি মামলা করেছে। ১০৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ওই মামলা করা হয়। এছাড়া ঋণের টাকা আদায়ে অগ্রণী ব্যাংকও একটি মামলা করেছে। এগুলো বিচারাধীন রয়েছে।
বেসিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এর কিছু নবায়ন করা হলেও ফের খেলাপি হয়ে গেছে। এসব কারণে বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতির পুরো অর্থই এখন খেলাপি।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৫৬টি এবং পরের বছর আরও পাঁচটি মামলা করে দুদক। ৬টি মামলার বিচারের রায় হয়েছে। এতে ৩৬ ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ৬৬ জনের জেল-জরিমানা হয়েছে। বাকিগুলো বিচারাধীন।
চট্টগ্রামের নুরজাহান গ্রুপ ২২টি ব্যাংক থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যার পুরোটাই এখন খেলাপি। ২০১৪ সালে সোনালী ব্যাংক চেক জালিয়াতির একটি মামলা করেছে গ্রুপের চেয়ারম্যান জহির আহমেদ ও এমডি টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে।
কমার্স ব্যাংক একটি মামলা করেছে। ২০১৬ সালে চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি জামিনে বের হন। অগ্রণী ব্যাংকের ২৫৯ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে ২০১৯ সালে দুদক নুরজাহান গ্রুপের এমডি-চেয়ারম্যানসহ তিন ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালকরা ৫০০ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। ওইসব ঋণ এখন খেলাপি। ২০২০ সালে দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।
২০১৯ সালে ৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতি বা বাবুল চিশতির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আরও ১৩টির তদন্ত চলছে।
একটি সরকারি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখা ও মহিলা শাখায় জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ঋণের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা আদায়ে ব্যাংক মামলা করেছে।
পিকে হালদার একটি ব্যাংক ও পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মহল থেকে ৩০টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে দুদকও কয়েকটি মামলা করেছে। আরও ঘটনার অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে।
সোনালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখা থেকে কয়েকটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক মামলা করেছে। এগুলো এখন বিচারাধীন।
সূত্র: যুগান্তর