কুমিল্লার একটি মণ্ডপে হামলার মধ্য দিয়ে গত ১৩ অক্টোবর দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে। দ্রুত এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। একাধিক স্থানে ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি মাঠে নামে বিজিবি। নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের কথা জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাড়ানো হয় গোয়েন্দা নজরদারি। সহিংসতা বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও আসে কঠোর নির্দেশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দফায় দফায় বৈঠকের মাধ্যমে কর্মকৌশল ঠিক করে। কিন্তু এত কিছুর পরও দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। গত শুক্রবার রাতেও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় একটি মন্দিরে আগুন দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই রাতে মন্দিরে ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায়।
এভাবে একের পর এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় নিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়টিই বারবার সামনে আসছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঠেকাতে প্রশাসন কতটা সজাগ- সেই প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
একের পর এক হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে। নিরাপত্তা নিয়ে তাদের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছে। হিন্দুদের বাড়ি, মন্দির-মণ্ডপে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবিতে গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে।
শুক্রবার দেশের ৪৭ বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে বলেন, ‘কুমিল্লায় হামলার পর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও সতর্ক, সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল। ওই ঘটনাকে (কুমিল্লার ঘটনা) কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও সাম্প্রদায়িক হামলা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, যার দায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এড়াতে পারে না। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ কী, তা খুঁজে বের করতে হবে।’
বিবৃতিতে এও বলা হয়, অতীতের মতো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিহত না করে একে অপরকে দোষারোপ করছে। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের দোষারোপের রাজনীতি প্রকৃত অপরাধীদের আড়ালে রাখতে সহায়তা করে।
একের পর এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রশাসনের সার্বিক নিরাপত্তায় ঘাটতি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই জঙ্গিসহ এ ধরনের অপরাধীরা সব সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। তবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চৌকস সদস্যরা সোচ্চার থাকায় দুর্বৃত্তরা তেমন সুবিধা করতে পারছে না। শক্ত নজরদারির মধ্যেই বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর দিয়ে জঙ্গি হামলা এবং মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। যদিও অচিরেই এ ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।’
একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করতে সোচ্চার এ ধরনের অপরাধীদের দমন করা শুধু র্যাব-পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর একার কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ আপামর জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সোচ্চার হতে হবে; জোরদার করতে হবে তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থাও।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেছেন, ‘এভাবে চলতে পারে না। অবশ্যই এসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। সরকারকে আরও উদ্যোগী হয়ে ভূমিকা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে সরকারের কাছে আমরা একটা সুপারিশ দিয়েছিলাম। এখন আরও বৃহৎ আকারে সুপারিশ পাঠাব। অবশ্যই সংখ্যালঘুদের ওপর এ ধরনের আক্রমণ বন্ধে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
সাবেক সচিব মো. রেজাউল আহসান বলেছেন, ‘সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় ছিল বলেই আমি মনে করি। কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালালে সেখানে আসলে করার কিছু থাকে না। হঠাৎ করেই একযোগে হামলা চালালে তা প্রতিহত করা সত্যিই কঠিন। তবু প্রশাসনকে আরও সক্রিয় থাকতে হবে।’
একসময় কুমিল্লার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে আসা রেজাউল আহসান আরও বলেন, ‘কুমিল্লার ঘটনার পর সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা আরও সক্রিয় হওয়া দরকার। দেশে অশান্তি সৃষ্টির জন্য একটি গোষ্ঠী সব সময় সক্রিয় থাকে। তাদের প্রতিহত করতে হলে সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি জনগণকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার মন্দিরে হামলার পর দেশের অন্তত ১৮টি জেলায় মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় শুক্রবার পর্যন্ত ১০২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২০ হাজার ৬১৯ জনকে। এদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ৫৮৩ জন। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে র্যাব-পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে র্যাব পীরগঞ্জের ঘটনার দুই হোতাকে গ্রেপ্তার করেছে। সহিংসতা ঠেকাতে ৩৭ জেলা ও তিন মহানগরীতে বিজিবি মোতায়েনের কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারপরও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর বন্ধ হচ্ছে না।
পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘আমরা এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে তৎপর আছি। গভীর রাতে যদি দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়, তা হলে আমাদের কতটুকুই বা করার আছে। সব জায়গায় তো পুলিশ দেওয়া সম্ভব নয়। তারপরও আমরা আমাদের সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করছি। এ কাজে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকেও এগিয়ে আসা উচিত।’
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলেন, ‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এসব ঘটনায় প্রশাসন নীরব রয়েছে। ফেনীতে প্রশাসনের কাছে সকাল থেকে নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। পূজা উদযাপন পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল ৩টার পরে বিসর্জন দেবে, প্রশাসন বলল সকাল ১১টার ভেতরে বিসর্জন দিতে। এরপর মণ্ডপগুলো খালি হয়ে গেল এবং তাণ্ডব চালানো হলো। প্রশাসনের কাছে তো সব তথ্য ছিল। তারা বলছে, উপরের কোনো নির্দেশ পায়নি।’ প্রশাসনের ব্যর্থতায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানান নির্মল কুমার।
সূত্র: আমাদের সময়.কম