লোকে বলে—সুন্দরবনে প্রতি পদে পদে বিপদ। কথা ফলতে বনে যেতে হয়নি, বিপদ টের পেলাম ভ্রমণের শুরুতেই। খুলনাগামী বাসের টিকিট ফোনে বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। কাউন্টার থেকে বলা হয়েছিল, বাস ছাড়ার আধ-ঘণ্টা আগে আসলেই হবে। হঠাৎ ঘণ্টা তিন-চারেক আগে জানালো, অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে টিকিট কাটতে হবে। নইলে বুকিং বাতিল। কারণ, টিকিটের চাহিদা বেশি। সুজন ভাইকে বললাম, টিকিট কেটে রাখতে। তিনি গিয়ে কিনে রাখলেন। বাস ছাড়ার সময়ের বেশ আগেই কাউন্টারে গেলাম দুজনে। কিন্তু বাসের খবর নেই। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর বাস এলো। ঢাকার আব্দুল্লাহ্পুর থেকে ছাড়লো রাত ১২টারও পরে!
শুরুতেই প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের দেরির পরও স্বস্তি—এসি বাস পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে অবৈধ ভিআইপি সুবিধা পাবে। খুলনা পৌঁছাতে তাই দেরি হবে না। কিন্তু কোথায় কী! গাড়ি তো সাধারণ লাইনেই। ঘাটে যাওয়ার কয়েক কিলোমিটার আগে থেকেই যানবাহনের লম্বা সারি। শঙ্কাটা তখনই জাগলো—সকালে মোংলা পৌঁছাতে পারব তো? মাঝরাতে দুশ্চিন্তা দূরে ঠেলে ভ্রমণের ক্লান্তি আর কর্মময় দিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘুম দিলাম। সকালে উঠে চক্ষু চড়কগাছ! এ কী এখনও লম্বা সারির পেছনে। সামনে শত শত যান।
সকালেই ফোন দিয়ে খবর নিলেন মিজান ভাই। তার লঞ্চেই যাব সুন্দরবন। তিনি জানালেন, বাকি সব পর্যটক মোংলা চলে এসেছেন। শুধু আমরাই এখনও পদ্মার এপার—মানিকগঞ্জে! আমরা যদি সকাল সাত-সাড়ে সাতটার মধ্যে ফেরি পার হতে পারি তাহলে লঞ্চ অপেক্ষা করবে। অভাগা যেদিকে চায়, সাগরও শুকিয়ে যায়—সকাল ৯টায় উঠলাম ফেরিতে। মিজান ভাইকে বললাম, পর্যটকদের হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম স্পটে ঘুরাতে থাকেন আমরা আসছি। নদী পার হয়েও শান্তি নাই, মনে হচ্ছে গাড়ি চলছে ঠেলাগাড়ির বেগে! উল্টোদিকে সময়ের রকেটগতি! মিজান ভাইয়ের হাজারো ফোনকল, সাথে বন্ধু তানভীরেরও। ঠেলতে ঠেলতে দুপুর ১টায় পৌঁছলাম খুলনা। মিজান ভাইয়ের কথায় তার সাউদার্ন ট্যুরসের ছোট লঞ্চটির সারেং পর্যটকবাহী লঞ্চটিকে সুন্দরবনের ভেতরে না নিয়ে আশপাশ দিয়েই ঘুরাচ্ছে। অবশেষে মোটরসাইকেলে চড়ে বিকাল ৩টায় পৌঁছলাম মোংলা। লঞ্চ অপেক্ষা করছে চাঁদপাই ফরেস্ট রেঞ্জে। এবার মিশন চাঁদপাই।
মোংলা থেকে মোটরসাইকেলে চড়ে চাঁদপাই পানে ছুট। মাঝে সড়কের কাজ চলছে। তাড়ার মাঝেও হাঁটা! একরাশ বিরক্তি নিয়ে হেঁটে চলছি মোটরসাইকেলের সাথে। ৪টার পর উঠলাম লঞ্চে। গিয়েই গোসল ও নামাজ সেরে খাওয়া-দাওয়া। লঞ্চের সারেং ও অন্যান্য কর্মীরা জানালেন আমাদের জন্য সারাদিন প্রায় কাছাকাছি জায়গায় ঘুরাঘুরির কাহিনি। দু-একজন পর্যটক কিছুটা অনুমান করতে পারলেও সুন্দরবনের ভেতরেই লঞ্চ ঘুরতে থাকায় বিরক্ত বোধ করেননি। বনভ্রমণ উপভোগ করেছেন। শুরুতেই সারেংকে বলে দিলাম, দিনের এই ঘাটতি রাতে বেশি চালিয়ে পুষিয়ে দেবেন। তিনি হাসিমুখে রাজি হয়ে গেলেন। খুশি মনে চা হাতে নিয়ে গেলাম লঞ্চের ছাদে।
অপূর্ব—শান্ত শ্যালা নদীর দুই পাশ ঘিরে আছে শ্বাসমূলীয় বাদাবন (স্থানীয় ভাষায় সুন্দরবনের আরেক নাম বাদাবন)। উড়ে যাচ্ছে বক। পাতার ফাঁকে চোখ খুঁজছে হরিণকে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া জুড়িয়ে দিচ্ছে প্রাণ। এক্ষণে মনে হচ্ছে, কী মোক্ষম সময়েই না গরম চায়ে দিচ্ছি চুমুক! মিজান ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল আমাদের জন্য বরাদ্দ করা কক্ষ দেখে। দোতলায় একেবারে লঞ্চের সম্মুখে রঙ্গিন কাঁচেঘেরা দুই বিছানার কক্ষটি আমাদের দুজনের জন্য বরাদ্দ। আগে লঞ্চ দেখলে ঠিক এই কক্ষই চাইতাম। এখানে বিছানায় শুয়েই সুন্দরবনের পুরো সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
সন্ধ্যার বনে ক্লান্ত পাখিদের ফেরা দেখতে ভালোই লাগছে। ওরা ফিরছে, আমরা যাচ্ছি। খানিক দূরে মিললো হরিণের দেখা। নদীর মাঝ থেকেই দেখা যাচ্ছে তীর ঘেঁষে হাঁটা দু-তিনটি হরিণ। কেওড়া, সুন্দরী, বাইন নানা ধরনের গাছের ফাঁকে ফাঁকে জন্মানো ছোট গাছের পাতা খাচ্ছে; নেই ফেরার কোনো তাড়া। দেখতে দেখতে ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে হরিণগুলো, নামছে আঁধার। নদীতে ভাটা চলছে। বনের গাছগুলোর শ্বাসমূল তাই দেখা যাচ্ছে। জোয়ারে পানি বাড়লে ডুবে যায় শ্বাসমূল। পানির উচ্চতা কতটুকু বাড়ে তা গাছগুলো দেখেই বুঝা যায়। সারিবদ্ধ সব গাছের ডাল ও পাতা ঠিক একই সমান্তরালে; শেকড়ের কয়েক ফুট উপরে। দেখে মনে হচ্ছে কারা যেন সুন্দরভাবে ছেঁটে রেখেছে। কোনো মালি নয়, নদী-খালের পানিই এই কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে যুগ যুগ ধরে।
জোয়ারে পানি বাড়লে ডুবে যায় শ্বাসমূল
জোয়ারে পানি বাড়লে ডুবে যায় শ্বাসমূল
নদীর পাশ দিয়ে বনের বুক চিরে চলে গেছে হাজারো খাল। রাতে জ্যোৎস্নার আলোয় খালগুলোকে মনে হচ্ছে দূরের কোনো পথ। যেখান দিয়ে হারিয়ে যাওয়া যায় প্রকৃতির মাঝে। নিরব বন যেন ঘুমুচ্ছে তার সন্তানদের কোলে নিয়ে। এরই মাঝে দূরের নদী ও খালে দেখা যায় টিমটিমে আলো। ঢেউয়ের তালে আলোও নাচছে। কাছে আসতে দেখা মেলে ছোট জেলে নৌকার। সেখানেই জ্বলছে আলো। নিবিড় মনে নদীতে জাল ফেলে যাচ্ছে জেলেরা। কোনো নৌকায় একজন, কোথাও দু-তিনজন। শুধু রাত নয়, এই নৌকায় তার কাটবে একাধিক দিন। কয়েকদিনের খাবার আছে সাথে, রান্নার জন্য হাঁড়ি, চুলাও। মাছ ধরা শেষে কয়েকদিন পর ফিরবে লোকালয়ে। বনের স্থলভাগের খানিকটা দূরে খালে নৌকা আটকে সেখানেই রাত কাটে তাদের। স্থলভাগ থেকে কিছুটা দূরে থাকায় বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয় কম। কিন্তু কুমির? সুন্দরবন তো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একার রাজত্ব নয়, এখানে নদী শাসনে আছে কুমির! একেই বলে—ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির।
কুমিরের ভয় জেলেরা করে না। বলা যায়, ভয়কে দূরেই রাখতে হয়। নইলে পেট চলবে না। শুধু একার নয়, ঘরে বসে আছে পরিবারের বাকি সদস্যরা। কুমিরের মুখের সামনে থেকেই তাই আহারের ব্যবস্থা করতে হবে! গবেষকদের মতে, বর্তমানে মাত্র শ’খানেক লোনাপানির কুমির রয়েছে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে। অথচ পূর্বে ধারণা ছিল, প্রায় সাড়ে চারশ’ নদী-খালে ঘেরা এই বনে অন্তত হাজারখানেক কুমির রয়েছে। সংখ্যা কমে গেলেও দিনে এদের নদীর বিভিন্ন তটে শুয়ে রোদ পোহাতে দেখা যায়। ভয়টা তাই থেকেই যায়। আগেরবার সুন্দরবন ভ্রমণে পশুর নদ সংলগ্ন খালে নৌকায় চড়ে ঘুরার সময় বেশ কাছ থেকে ১০-১১ ফুট লম্বা কুমির দেখার স্মৃতি এখনও তরতাজা। সুন্দরবন চষে বেড়ানো ওই জেলেদের স্মৃতিপটে এ ধরনের হাজারো ঘটনার আনাগোনা। সাহসী এই যোদ্ধাদের মনেও তাই ভয় উঁকি দেয় বইকি!
ভ্রমণের ক্লান্তি সেই বিকালেই শুষে নিয়েছে সুন্দরবন। শীতকালের শুরুর দিকের ঠান্ডা বাতাসেও লঞ্চের ছাদে বসে থাকতে মন্দ লাগছে না। সারেং মাঝে মাঝে সার্চলাইটের আলো ফেলছেন বনের ভেতর। সাথে উৎসুক চোখের চাহনি ছুটে যাচ্ছে—যদি মেলে বাঘ মামার দেখা! নিশাচর প্রাণীটি হেঁটে বেড়ায় সন্ধ্যা থেকে ভোরের মধ্যবর্তী সময়ে। না, বনের রাজা বোধহয় এ অঞ্চলে আজ আসবেন না। দু-একটা শূকরের দেখা মিললো। সাথে তাদের দৌড়ে চলার আওয়াজও।
ভালো লাগছে বয়ে চলা ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ।
ভালো লাগছে বয়ে চলা ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ।
ধীরে চলা লঞ্চের গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের আওয়াজ বেজে চলছে বনের নিস্তব্ধতা ভেদ করে। কিছুক্ষণ পর নদীর এক প্রান্তে নোঙ্গর করল লঞ্চ। শান্ত পরিবেশে এখন শুধু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। হঠাৎ পাতা বা ডাল ঝরার শব্দ, কিংবা বন্যপ্রাণীর দৌড়ে যাওয়ার আওয়াজ কানে আসছে। বিছানায় শুতেই ঢেউয়ের দুলুনির তালে তালে চলে চলে এলো ঘুম। ঘুমের ঘোরেও কানে বাজছে ছলাৎ ছলাৎ। বাদাবনের জেলেদের সাথে আমরাও ভাসছি কুমিরের জলে। (চলবে…)
সূত্র: যুগান্তর