কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মসজিদ ও মাদরাসায় সাম্প্রতিক হামলায় ৬ জন নিহত হওয়ার পর ক্যাম্পে এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ওই হামলার জন্য স্থানীয় রোহিঙ্গারা আরসাকে দায়ী করছে। যদিও আরসা হামলার দায় অস্বীকার করেছে।
এ অবস্থায় ক্যাম্পে নিরাপত্তা বাড়ানো হলেও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক কাজ করছে। ক্যাম্পের বাইরে একের পর এক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে স্থানীয় অধিবাসীদেরও মধ্যেও ভয়-আতঙ্ক বাড়ছে।
ক্যাম্পে সবচে বড় হামলা
গত ২২ অক্টোবর রাতে ১৮ নম্বর ক্যাম্পের সবচেয়ে বড় মসজিদ ও মাদরাসায় হামলা হয়।
সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, হামলার ভয়াবহ চিত্র- মসজিদ, মাদরাসা এবং হেফজখানার দরজা জানালায় এলোপাথাড়ি কোপানো হয়েছে। মসজিদের ভেতরে রয়েছে রক্তের কালসিটে দাগ। ওই হামলায় ঘটনাস্থলেই চারজন এবং হাসপাতালে নেয়ার পর আরো দুজনের মৃত্যু হয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এরকম হামলা আর একসাথে এত মানুষ খুন এর আগে হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ৩টার পর সশস্ত্র রোহিঙ্গা হামলা চালায়। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে তারা তছনছ করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর ‘দিনে সরকারি বাহিনী, রাতে সশস্ত্র বাহিনী’।
রোহিঙ্গা সঙ্কট কেন আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি?
হামলার সময় তারা শুধু এই মসজিদ-মাদরাসায় আক্রমণ করেই থেমে থাকেনি, আশপাশের প্রতিটি বাড়ির সামনেও পাহারা বসায় যাতে কেউ প্রতিরোধ করতে না পারে। আশপাশের রোহিঙ্গাদের দাবি কয়েক শ’ রোহিঙ্গা ওই হামলায় অংশ নিয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, এখনো তাদের হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কথা বলতেও ভয়-আতঙ্ক কাজ করছে সবার। ঘটনার পর সার্বক্ষণিক পুলিশের পাহারা বসেছে, চলছে দিনে রাতে টহল। কিন্তু ক্যাম্পের পরিস্থিতি থমথমে বলেই মনে হয়েছে।
মসজিদ-মাদরাসায় কেন হামলা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচনা আছে এ মসজিদ-মাদরাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ চলছিল আরসার সহযোগী সংগঠন উলামা কাউন্সিলের সাথে। গুঞ্জন আছে হামলার শিকার মাদরাসাটির পরিচালনায় ছিল ‘ইসলামী মাহাস’ নামে আরেকটি রোহিঙ্গা সংগঠন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতৃস্থানীয় একজন রোহিঙ্গা বলছিলেন, এ মাদরাসা ও মসজিদের অবস্থান ছিল স্পষ্টতই আরসার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তারা এখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। তাদের সমর্থন না করায় আগেও হুমকি দিয়েছে। বলা হয়েছে, মাদরাসা ছেড়ে দিতে। তারা (আরসা) চেয়েছে এই এলাকায় জন্য এই মাদরাসা তাদের একটা হেডকোয়ার্টার হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এই মসজিদ মাদরাসায় এত ভয়াবহ হামলা কেন?
এ ব্যাপারে ওই রোহিঙ্গা বলেন, অনেক আগে থেকেই এই মাদরাসা তাদের টার্গেট ছিল। মাদরাসায় সাড়ে ৩৫০-এর মতো রোহিঙ্গা ধর্মীয় শিক্ষা নেয়।
সম্প্রতি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা মহীবুল্লাহ হত্যার পর বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে এই মাদরাসা কেন্দ্রিক রোহিঙ্গারা। এছাড়া মহীবুল্লাহ হত্যার পর ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্দেশে রোহিঙ্গাদের অনেকে পাহারা দেয়া শুরু করে।
১৮ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গারাও পাহারা দিত এবং গত কয়েক সপ্তাহে তারা ৪ থেকে ৫ জন দুস্কৃতিকারীকে ধরতে সহায়তা করেছে। এছাড়া ওই মসজিদের খুতবায় ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বয়ান করা হতো। যা আরসার বিপক্ষে যায়।
ক্যাম্পের বাজার-ঘাট দোকানে চাঁদাবাজি এবং নারী নির্যাতন নিয়েও সোচ্চার ছিল হামলার শিকার মসজিদ ও মাদরাসার পরিচালনার সাথে যুক্তরা।
আরসাকে দায়ী করছে রোহিঙ্গারা
সার্বিকভাবে ক্যাম্পে এবারের হামলার পেছনে রোহিঙ্গারা আরসাকে দায়ী করছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার উপস্থিতি স্বীকার করে না বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তাদের ভাষায়, এখানে আধিপত্য কায়েম করতে অনেক গ্রুপ সক্রিয়। তারা আরসার নাম ব্যবহার করে।
এ দিকে ওই হামলার ঘটনায় এক সপ্তাহের মধ্যে ডজনের বেশি আটক হয়েছে বলে জানায় ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএনর কর্মকর্তারা। কিন্তু তাদের ভাষ্য, ক্যাম্পে এখন রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপ আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরোধের কারণেই পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যাচ্ছে।
তবে দায়িত্বশীল রোহিঙ্গারা বলছেন, ক্যাম্পে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে চায় আরসা। আল ইয়াকিন নামেও আরসা পরিচিত। আর তাদের সমর্থিত গ্রুপ উলামা কাউন্সিল ক্যম্পের বেশিরভাগ মসজিদ-মাদরাসা নিয়ন্ত্রণ করে।
হামলার শিকার মাদরাসা পরিচালনার সাথে ইসলামী মাহাস নামের একটি রোহিঙ্গা সংগঠনের নাম এলেও রোহিঙ্গাদের অনেকে ক্যাম্পে সংগঠনটির অস্তিত্ব স্বীকার করতে চান না। তবে আরসা সন্দেহে ক্যাম্পে বেশকিছু রোহিঙ্গা আটক হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
ক্যাম্পে আতঙ্কে রোহিঙ্গারা
ক্যাম্পে নিরাপত্তা পরিস্থিতি দিন দিন আরো নাজুক হয়ে পড়ছে বলেও মনে করেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। সেখানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়ে যাচ্ছে বলেই তাদের অভিজ্ঞতা।
ক্যাম্পের ভেতর চাঁদাবাজি, মাদক বাণিজ্য এবং নানা রকম অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটছে অহরহ। ক্যাম্পে মারামারী রক্তক্ষয়ী সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ রোহিঙ্গারাও নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন।
রোহিঙ্গা নারীদের একজন বলেন, ‘আমরা এখন বেশ অশান্তির মধ্যে আছি। খুব চিন্তা হয়। খুব ভয় লাগে, খুব ভয় হয়।’
মসজিদের পাশে অবস্থানরত আরেকজন নারী ওই হামলার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলছিলেন, ‘রাতে ঘুম হয় না আমাদের। নামাজ-দোয়া পড়ি। আবার মারামারি কাটাকাটি হয় কি না এ জন্য আতঙ্ক।’
এদিকে নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ ঠেকাতে ক্যাম্পের চারদিকে এখন কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই অপরাধ কর্মকাণ্ড।
ভুক্তেভোগী স্থানীয় জনগণ
ক্যাম্পের মধ্যে খুনোখুনি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়েছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও।
এসব এলাকায় ইদানিং ডাকাতি এবং অপহরণের মতো অপরাধ ঘটছে, যার শিকার হচ্ছেন স্থানীয় জনগোষ্ঠী। আর এসব অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে।
জাদিমুরা ক্যাম্পের পাশে এক বাঙালী বৃদ্ধা জানান, তার এক ছেলে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। যে হামলায় জড়িতদের বেশিরভাগই ছিল রোহিঙ্গা। তার আরেক ছেলে ক্যাম্পের পাশে নিজের ঘরবাড়ি ফেলে এ ছাপড়া ঘরে বসবাস শুরু করেছেন রোহিঙ্গাদের হুমকি পেয়ে।
রোহিঙ্গাদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বেশি অত্যাচার শুরু করছে তারা। বেশি হামলা করে। অনেক মানুষকে মেরে ধরে টাকা নেয় তারা।’
টেকনাফের একজন সিএনজি চালক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে আত্মীয়ের এক বাড়িতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানান, রোহিঙ্গারা ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাকে পাহাড়ে বন্দী করেছিল।
তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পের কাছে আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আসার পথে ডাকাত রোহিঙ্গারা আমাকে ধরে পাহাড়ে নিয়ে যায়। টাকার জন্য বেঁধে রাখে। পরে আত্মীয়-স্বজন সোনাদানা বন্ধক রেখে দুই লাখ টাকা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করে।’
টেকনাফ থানার পুলিশের তথ্য, গত এক বছরে সেখানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১৫টি অপহরণ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অন্তত ১৩ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: হাফিজুর রহমান জানান, এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। এখানে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা আছে যারা অপহরণ এবং ইয়াবা কারবারের সাথে জড়িত। বেশিরভাগ সময় তারা পাহাড়ে অবস্থান নেয়। সুযোগ বুঝে ছদ্মবেশে লোকালয়ে আসে এবং অপরাধ করে পাহাড়ে চলে যায়। গহীন, দুর্গম পাহাড়ে।’
উখিয়া টেকনাফের ক্যাম্পগুলোর আশপাশেই রয়েছে পাহাড়, জঙ্গল। নিকটেই সীমান্ত এলাকা। ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শেষে অনায়াসে এসব গহীন জঙ্গল বা দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া কঠিন কিছু নয়। এ পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের ভেতরে বাইরে যেভাবে অপরাধ বাড়ছে তাতে এ এলাকার ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে।
সূত্র : বিবিসি