বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের নিস্তার নেই। ব্যয় এবং ভোগান্তি থেকে মুক্ত করতে সরকার গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করেছিল। কিন্তু এই দ্বৈত খপ্পর থেকে তারা বের হতে পারেনি। একবার ১২শ’ টাকা করে ফি দিয়ে তারা কেন্দ্রীয় পরীক্ষা দেয়। সেই ফল নিয়ে এখন আবার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আরেক দফা ফি গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের মাথায় হাত পড়েছে। এই সংকট উত্তরণে তারা সরকারের ত্বরিত হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী বলছেন, লাভ হয়েছে একটিই। তা হচ্ছে, বারবার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে না। কিন্তু ব্যয় কোনো অংশে কমেনি। বরং বেড়েছে। একই অবস্থা ভোগান্তির ক্ষেত্রেও। যদি মেডিকেলে ভর্তির মতো অভিন্ন পরীক্ষার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মেধাক্রম এবং পছন্দ তালিকা ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ বণ্টন করে দেওয়া হতো তাহলে তারা খরচ এবং এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে দৌড়ানোর ভোগান্তি থেকে রক্ষা পেতেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ শনিবার বলেন, ‘কমিটির দায়িত্ব ছিল পরীক্ষা নিয়ে জিআরই-টোফেলের মতো শিক্ষার্থীদের একটা সমন্বিত স্কোর দেওয়া। যে কারণে আমরা কোনো পাশ-ফেলের ফল না দিয়ে কে কত পেয়েছে সেটি প্রকাশ করেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের একাডেমিক কাউন্সিল ও ভর্তি কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সার্কুলার দিয়ে ভর্তি করবে। শিক্ষার্থীরা এখানে সবচেয়ে বড় যে সুবিধা পেয়েছে সেটি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় বা অনুষদ ও বিভাগ ধরে পরীক্ষা দেওয়া লাগছে না। তিনটি পরীক্ষা দিয়ে তিন গুচ্ছের (জিএসটি, কৃষি এবং প্রকৌশল) ত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে। পরীক্ষা কমে যাওয়ার কারণে তাদের ব্যয় এবং ভোগান্তি কমেছে। সুতরাং এ দুটি বেড়েছে-এমন পর্যবেক্ষণ সঠিক নয়।’
সরকারি ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছের নাম ‘জিএসটি’ (জেনারেল, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি)। এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি করবে। এ ক্ষেত্রে অন্য শর্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিক করতে পারবে। ১২শ টাকা ফি দিয়ে এই পরীক্ষায় আবেদন করতে হয়েছিল ভর্তিচ্ছুদের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা ফি নেবে কিনা সেটি আগে আলোচনা হয়নি। প্রথমে এই ফি ৬শ টাকা নির্ধারণের কথা ছিল। কিন্তু প্রত্যাশার চেয়ে কম আবেদনকারী পাওয়ায় খরচ পোষাতে গিয়ে পরে ফি বাড়ানো হয়। ৩ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থী এতে অংশ নিতে আবেদন করেছিল।
ভর্তিচ্ছুরা বলছেন, শুরুতে তারা ভেবেছিলেন, খরচের পর্ব এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই তারা ১২শ টাকা খরচ করা নিয়ে আপত্তি তোলেননি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, খরচ আগের মতোই আছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আগের মতোই অর্থ আদায়ে নেমেছে। আগে ফি নিয়ে পরীক্ষা নিত। অর্থাৎ পরীক্ষার ব্যয় বাবদ কিছু শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করত। এখন কেবল আবেদন মূল্যায়ন করে মেধাক্রম তৈরির জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ ধার্য শুরু হয়েছে। অবস্থা এমন যে, কোথাও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অনুষদ ধরে আবেদন করে একাধিক দফায় ফি পরিশোধ করতে হবে। অথচ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের যেমন একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, তেমনি একটি আবেদন ও একবার ফি নেওয়া হলেও কিছু সাশ্রয় হতো। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের আগের মতোই ভর্তির সুযোগ নিশ্চিতে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয় আবেদন নিয়ে ছুটতে হবে। অথচ মেডিকেল কলেজে ভর্তির মতো পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর পছন্দ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় বণ্টন করে দিলে এই ঝক্কি হতো না।
শিক্ষার্থীদের উল্লিখিত অভিযোগের প্রমাণ মেলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) সার্কুলার থেকে। প্রতিষ্ঠানটি গত ৩ নভেম্বর সার্কুলার জারি করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, অনুষদভিত্তিক ৬৫০ টাকা আবেদন ফি ধার্য করেছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ৪টি অনুষদ আছে। এখন কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি নিশ্চিত করতে চাইলে তাকে ২৬শ টাকা দিয়ে আবেদন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত আবেদন নেবে।
তুহিন হোসেন নামে এক প্রার্থী ফোন করে বলেন, এখন যদি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এই কাজ শুরু করে তাহলে একজন শিক্ষার্থীর ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাবে। কেননা কোথায় ভর্তির সুযোগ হবে তা আগাম কারও পক্ষে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হবে। বিশেষ করে, যেসব ভর্তিচ্ছু তুলনামূলক কম নম্বর পেয়েছে এবং যাদের এসএসসি-এইচএসসিতে জিপিএ কম, তাদের ঝুঁকিমুক্ত থাকতে এই কাজটি বেশি করতে হবে।
জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক ছাত্রী জানান, পরীক্ষা নিতে প্রশ্ন তৈরি, মুদ্রণ, উত্তরপত্রের কাগজ কেনাসহ নানান খরচ আছে। এখন সেই খরচ না থাকার পরও যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অস্বাভাবিক হারে ফি নির্ধারণ করে তাহলে তো বলতেই হবে-অতিরিক্ত টাকা কামানোর মোহ থেকে সংশ্লিষ্টরা এখনো ফিরে আসতে পারেননি।
তরিকুল ইসলাম নামে একজন জানান, ‘ভর্তিচ্ছুদের অনেককেই একাধিক অনুষদে আবেদন করতে হবে। একটি হচ্ছে, নিজে যেই বিভাগে এইচএসসি পাশ করেছে সেটির পাশাপাশি বিভাগ পরিবর্তনের জন্য পছন্দের এক বা একাধিক অনুষদে আবেদন করবে। আর এমনটি হলে এক শিক্ষার্থীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন বাবদই ২ হাজার টাকা ব্যয় হবে। ফলে কেউ ১০টিতে আবেদন করলে ২০ হাজার টাকা খরচ হবে। এর বাইরে যাতায়াত ব্যয় তো আছেই। এতে উচ্চশিক্ষায় ভর্তিটা দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের জন্য আরও কঠিন করে তোলা হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন বলেন, ‘অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় আমার জানা নেই। তবে আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে একটি বিভাগের শিক্ষার্থীর কাছ থেকে একটিই আবেদন নেব। এজন্য একটিই ফি নেওয়া হবে। বিভাগ পরিবর্তনের বিষয়টিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’
পুনঃনিরীক্ষা আজ থেকে : এদিকে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় ফল নিয়ে অসন্তুষ্টদের ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন আজ নেওয়া শুরু হবে। এর জন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার টাকা। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য আজ (রোববার) সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।
সূত্র: যুগান্তর