তালেবান আফগানিস্তান দখল করতেই দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সামনের মাস থেকেই চরম খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, দেশটির অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হতে চলেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে আগাম সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তানে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩২ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগতে পারে বলে মনে করছে ডাব্লিউএফপি।
সংস্থাটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডেভিড বেসলি জানিয়েছেন, খাদ্য কর্মসূচির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তান। তালেবান সরকারের অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিই দেশটিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তালেবানরা সাধারণ নাগরিকদের বিন্দুমাত্র পরিষেবা দিতেও ব্যর্থ। জিনিসের দাম বেশিরভাগ মানুষেরই নাগালের বাইরে। এক বেলা খেতে পর্যন্ত পারছে না অর্ধেকের বেশি মানুষ। ইতোমধ্যেই বহু শিশু অনাহারে প্রাণ হারিয়েছে। তালেবানকে মদদ দিলেও আফগানিস্তানকে এখন আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষমতা নেই পাকিস্তানের।
আফগানিস্তানের এখন ক্ষুধার থেকে বাঁচতে চাই ২০ মিলিয়ন টন খাদ্যসামগ্রী। প্রবাসী বাঙালি মুন্তাসির সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছেন, ভারত ইতোমধ্যেই ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম দিতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু তালেবানকে ক্ষমতায় বসাতে পাকিস্তান সক্রিয় ভূমিকা নিলেও সাধারণ আফগানদের মুখে ভাত জোটানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই ইসলামাবাদের। এমনই মন্তব্য তার। পাকিস্তান এখন নিজেদের দায় এড়াতে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আফগানিস্তানের জন্য আর্থিক সাহায্য চাইছে।
আফগানিস্তানে বেশিরভাগ মানুষের হাতে পয়সা নেই। এরমধ্যে চলছে লুটপাট। খোদ তালেবান সেনারাও সাধারণ মানুষের সম্পত্তি লুট করছে। সাধারণ মানুষের আয় রোজগারের বেশিরভাগ রাস্তাই বন্ধ। বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ছে হাজার হাজার মানুষ। অনেকেই পাড়ি দিচ্ছে পাকিস্তানে। ইতোমধ্যেই ৯৩ হাজারেরও বেশি আফগান আশ্রয় নিয়েছে পাকিস্তানে। তোরখাম সীমান্তে মানুষের ঢল সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। অথচ তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার আগে বেশ ভালোই ছিল সেখানকার মানুষ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহারের পরই সেখানে ক্ষমতা দখলের জন্য তালেবানদের বিভিন্নভাবে এগিয়ে দেয় পাকিস্তান। দেশটিতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারই ছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআইয়ের মূল লক্ষ্য। আবার বর্ডার রোড ইনিশিয়েটিভ ছাড়াও আফগানিস্তানের বিশাল খনিজ সম্পদের টানে চীনও পাকিস্তানকে কৌশলগত সহযোগিতা দিয়েছে।
আতঙ্কই যেন আফগান নাগরিকদের ভবিতব্য হয়ে উঠেছে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটিকে প্রথমে গ্রাস করে তালেবান আতঙ্ক। ১৫ আগস্ট তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর আইসিস খোরাসানের নৃশংসতার আতঙ্ক তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এখন যুক্ত হয়েছে ক্ষুধার আতঙ্ক। সবমিলে আতঙ্কে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। পেটে ভাত নেই, অথচ তালেবানের নীতির অভাব নেই। শাসনের নামে দেশটিকে বরবাদ করে দিচ্ছে।
দেশটির আগের সরকারের আইনপ্রণেতা মহম্মদ মোহাকেক জানিয়েছেন, পশ্চিম কাবুলে এখনও পর্যন্ত ক্ষুধার জ্বালায় প্রাণ হারিয়েছে আট শিশু। সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই সংখ্যালঘু হাজারা জনগোষ্ঠীর। রুশ সংবাদ সংস্থা স্পুতনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তালেবান শাসনে সংখ্যালঘু ও নারীরাই সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন। এ কারণে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে হাজারা গোষ্ঠী ও শিয়া মুসলিমদের জন্য সাহায্যের আবেদন করেছেন মোহাকেক। পশ্চিম কাবুলের পাশাপাশি ঘুর প্রদেশেও অনাহার ও অপুষ্ঠিতে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল আফগান অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বিদেশি সাহায্য থেকে এলে তাকে সাহায্য নির্ভর দেশ বলে ধরা হয়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য। দেশটির দারিদ্র্যের কারণে বহু দিন ধরেই প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ অর্থ সাহায্য করেছে। কিন্তু এই অস্থির পরিস্থিতিতে কেউই আগের মতো আর্থিক সাহায্য করছে না। ফলে সেখানকার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বেহাল অর্থনীতির কারণেই মানুষের দারিদ্র্য চরমসীমায় পৌঁছেছে। তাই অবিলম্বে আন্তর্জাতিক মহল ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য।
এরইমধ্যে দেশটির বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুতের অভাবে অন্ধকারে গ্রাস হতে পারে দেশটির ঘুড়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও। দেশটির প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ৭৮ শতাংশই মিটে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাহায্য থেকে। বাকি ২২ শতাংশের জন্য অর্থ দিতো আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকার। কিন্তু ১৫ অগস্ট তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই বিদ্যুতের বকেয়া অর্থ জমা পড়ছে না। সাধারণ মানুষের খাবার যোগানে ব্যর্থ সরকার বিদ্যুতের বকেয়া মেটাবে এটা আশা করাও বেশ কঠিন। আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকার বিদ্যুতের খরচ বাবদ প্রায় ২ থেকে ২.৫ কোটি ডলার প্রতিবেশী দেশ উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও ইরানকে দিত। কিন্তু তালেবান সেই খরচ বহন করতে পারছে না। বিদ্যুৎ বিলের বোঝা সাড়ে ছয় কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যে এ অর্থ না দিলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে বলে পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিবেশী দেশগুলো জানিয়েছে।
দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালেবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালেবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালেবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে। মনে করা হয়, তালেবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালেবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালেবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
জাতিসংঘের ডাব্লিউএফপির কার্যনির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলির কথায়, ‘নিজেদের সম্পত্তি বিক্রি করেও আফগান নাগরিকরা নিজেদের খাবার ব্যবস্থা করতে পারছে না। তাই মনে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানবিক সংকট এখন আফগানিস্তানেই।’
জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংগঠনের ডিরেক্টর কিউ ডংয়ুর মতে, ‘শীতকালে আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অঞ্চলের সঙ্গে যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তাই এখনই সব জায়গায় খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক করা জরুরি। অন্যথায় প্রবল শীতে ক্ষুধার জ্বালা মারাত্মক চেহারা নেবে।’
তোরখাম সীমান্তে সাড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অ্যাম্বুল্যান্স। অসুস্থদের চিকিৎসার বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা করতে পারছে না তালেবান সরকার। এদিকে পাকিস্তান তাদের সীমান্ত খুলে দিতে নারাজ। তাই তোরখাম সীমান্তে অবস্থানরত তালেবান ইনচার্জ সৈয়দ গাজিউল্লাহ পাকিস্তানের কাছে সীমান্তে উদারতা দেখানোর অনুরোধ করেছেন। পাকিস্তানি মিডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘দেশে ওষুধের সংকট রয়েছে। আমাদের হাসপাতালগুলো চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত নয়। আমরা সীমান্ত দিয়ে রোগীদের প্রবেশের জন্য পাকিস্তানকে তার নীতি শিথিল করার অনুরোধ করছি।’
সীমান্ত সূত্রের খবর, ইতোমধ্যেই ৯৩ হাজারেরও বেশি আফগান পাকিস্তানে পালিয়ে এসেছে। আরও হাজার হাজার মানুষ দেশ ছাড়ার জন্য তোরখাম সীমান্তে অপেক্ষা করছে। যদিও এই মানবিক সংকটে চুপ ইমরান খানের সরকার। আসলে সাহায্য করার মতো সামর্থ্যও নেই ইসলামাবাদের।
সূত্র: সমকাল