রাজধানীর বাড্ডায় নিজ ফ্ল্যাটে খুন হন মনজিল হক (৩০)। চাঞ্চল্যকর এ খুনের প্রায় চার বছর পর সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে খুনের পরিকল্পনাকারী মামলার বাদী নিজেই। বাদী অর্থাৎ মনজিলের চাচা ফারুক মিয়াসহ মোট সাতজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে সিআইডি। ২৬ অক্টোবর আদালতে পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. শামসুদ্দিন। অন্য অভিযুক্তরা হলেন- মনজিলের সৎভাই ইয়াসিন হক, রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব, সীমান্ত হাসান তাকবীর, মনজিলের সৎমা লায়লা ইসলাম লিপি এবং মামা আবু ইউসুফ নয়ন। ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর আফতাবনগরের বি ব্লকের ৩ নম্বর রোডের বাসা থেকে মনজিলের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ওইদিনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী আবুল কালাম ও মনজিলের বান্ধবী শারমিন আক্তার নিশাকে আটক করা হয়। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানা যায়। তবে তাদের মামলায় সাক্ষী করেছে সিআইডি। ঘটনার দিনই মনজিলের চাচা ফারুক মিয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাত চারজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করেন বাড্ডা থানার এসআই কামরুল হাসান। এরপর তদন্তভার স্থানান্তর হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি)। পাঁচ মাস পর সেখান থেকেও মামলাটি স্থানান্তর করা হয় সিআইডিতে।
সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. শামসুদ্দিন জানান, দীর্ঘ সময় ধরে তারা মামলাটি তদন্ত করেছেন। যারা সরাসরি খুনে জড়িত এবং পরিকল্পনাকারী তাদের প্রত্যেকের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এর আগে ৩১ আগস্ট মামলার চার্জশিট দাখিলের বিষয়ে মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবুর মতামত নেওয়া হয়। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির ঢাকা মেট্রো উত্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার খালিদুল হক হাওলাদার জানান, চার্জশিটে আসামিদের ছয়টি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ঘটনাস্থলে পাওয়া আলামতের সঙ্গে আসামিদের ডিএনএ প্রোফাইলিংসহ যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। তারা মনে করেন এসব তথ্যে আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত হবে। আদালতসূত্র জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে সিআইডি। সিআইডির তদন্তে শুরু থেকে মামলার বাদী অসহযোগিতা করে আসছিলেন এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে প্রভাবিত করছিলেন। আর ঘটনার পর থেকেই প্রধান আসামি ইয়াসিন পলাতক ছিলেন। তবে তাকে নিখোঁজ দেখিয়ে ইয়াসিনের মামা আবু ইউসুফ নয়ন ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পলাতক ইয়াসিন মোবাইল ফোন নম্বর পরিবর্তন করে প্রথমে চুয়াডাঙ্গা, পরে সিলেট শহরে এবং সর্বশেষ চট্টগ্রাম গিয়ে ছদ্মনামে আত্মগোপনে থাকেন। তবে বাদী ইয়াসিনকে অপহরণের পর খুন করে লাশ গুমের তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালান। মনজিলের সঙ্গে তার সৎভাই ইয়াসিন ও সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপির মনোমালিন্য হয়। ২০১৭ সালের ২০ মে বাবা মইনুল হক মারা যাওয়ার দুই মাসের মধ্যে আফতাবনগরে নিজেদের কেনা অসম্পূর্ণ ফ্ল্যাটে একাই চলে যান মনজিল। সেখানে একাই বসবাস করতে থাকেন। ঘটনার এক মাস আগে ইয়াসিন তার ছোট মামা আবু ইউসুফ নয়নের সঙ্গে মনজিলকে খুনের বিষয়ে পরামর্শ করেন। এতে নয়ন সম্মতি দিয়ে খরচের জন্য ইয়াসিনকে ২০ হাজার টাকা দেন। মইনুল হক ঢাকায় থাকা দুটি ফ্ল্যাট, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা ৩৭ লাখ টাকা এবং কুমিল্লার হোমনায় কিছু সম্পত্তি রেখে যান। তিনি মারা গেলে মনজিলের সঙ্গে ওইসব সম্পদের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ইয়াসিনের মনোমালিন্য শুরু হয়। যে কারণে ইয়াসিন তাকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। মনজিল যে ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন তিনি খুন হওয়ার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই লায়লা ইয়াসমিন লিপি, ইয়াসিন হক, সৎবোন সাদিয়া হক, নাজিয়া হক ও ফারিয়া হকের নামে পিস ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে সাফ-কবালা দলিল করে নেন। জানা গেছে, চলতি বছরের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের শের শাহ কলোনি থেকে মনজিলের সৎভাই ইয়াসিনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তার দেওয়া তথ্যে রাজধানীর কোনাপাড়া থেকে রবিউল ইসলাম সিয়ামকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ মার্চ তারা মনজিল হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। ৪ এপ্রিল যাত্রাবাড়ী থেকে মাহফুজুল ইসলাম রাকিব আর ১২ জুন জুরাইন থেকে গ্রেফতার হন সীমান্ত হাসান তাকবীর।
সূত্র: বিডি প্রতিদিন