মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নে এবার লাল তালিকায় রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। দেশটির ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের’(এমসিসি) মূল্যায়নে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণসহ ২০ সূচকের মধ্যে ১৬টিতেই বাংলাদেশ রেড জোনে পড়েছে। গত ১৮ বছরের মধ্যে এই প্রথম এত বেশি লাল সূচকভুক্ত হলো দেশ। গ্রিন বা সবুজ জোনে রয়েছে মাত্র ৪টি সূচক। এবার নতুন করে অবনতি ঘটেছে চারটি সূচকে। আর উন্নতি ঘটেছে একটিতে। গত বছর ১৩টি সূচক ছিল রেড জোনে। প্রতিবছর ‘রেড’ এবং ‘গ্রিন’ রং দিয়ে সূচকের মান প্রকাশ করে এমসিসি। সম্প্রতি ২০২২ সালের জন্য বাংলাদেশের মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে মার্কিন এ সংস্থা (এমসিসি)।
লালসূচক বেশি পাওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডের (এমসিএফ) মোটা অঙ্কের অনুদান পাওয়া ফের অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। স্কোর কার্ডের উন্নতির ভিত্তিতে সাধারণত কোনো দেশকে এই ফান্ডে যুক্ত করা হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পক্ষ থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর চেষ্টা করেও এই ফান্ডে যুক্ত হতে পারছে না বাংলাদেশ। এবারও হলো না। এটাকে ব্যর্থতা হিসাবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং আমেরিকা ও জাপান ইউং-এর প্রধান শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী কোনো মন্তব্য করেননি। পরে কথা বলব বলে জানান। তবে ইআরডির অপর এক কর্মকর্তা বলেন, স্কোরের উন্নতি করাটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এমসিসি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এই মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারা আমাদের তথ্য খুব বেশি গ্রহণ করতে চায় না। ফলে এক্ষেত্রে উন্নতি করাটা প্রায় দুরূহ হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রেড জোনের সূচকগুলো হচ্ছে, কন্ট্রোল অব করাপশন (দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ), রাজনৈতিক অধিকার, সরকারের কার্যকারিতা, জমির অধিকার ও প্রাপ্যতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা, বাণিজ্য নীতিমালা, ফ্রিডম অব ইনফরমেশন (তথ্যের স্বাধীনতা), অর্থনীতিতে নারী ও পুরুষের সমতা, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা সূচক। এছাড়া আরও রয়েছে বেসামরিক লোকের স্বাধীনতা, আইনের কার্যকারিতা, ঋণপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা, ফিসক্যাল পলিসি (রাজস্বনীতি) এবং শিশু স্বাস্থ্য।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই প্রতিবেদনে বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বারবার একই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর কিছুই হয়নি। সেজন্য এই সূচক থাকছে লাল তালিকায়। সরকার হয়তো একটা ব্যাখ্যা দেবে। কিন্তু এ রকম যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে সেগুলো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কেননা সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হলে দুর্নীতি কমবে না। সরকারের উচিত এসব মূল্যায়ন আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এমসিসির প্রতিবেদনে সবুজ তালিকায় থাকা সূচকগুলো হচ্ছে-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, টিকা দেওয়ার হার, বিজনেস স্টার্ট আপ (ব্যবসা শুরুর)। এছাড়া গত বছর রেড জোনে থাকলেও এবার গ্রিন জোনে উঠে এসেছে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির সূচকটি। ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, অনেক বছর ধরে চেষ্টা করেও কোনো ফল হচ্ছে না। স্কোর উন্নতিতে ইআরডির তেমন কিছুই করার নেই। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে। তবে বিষয়টি অনেকটাই রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক অংশ কম আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনা মহামারির কারণে শিশুস্বাস্থ্যসহ কিছু সূচক নতুন করে রেড জোনে আসতে পারে। কেননা করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে এগুলোতে বেশি নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি।
সূত্র জানায়, ২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সূচক রেড জোনভুক্ত হলো ২০২২ সালের প্রতিবেদনে। গত ১০ বছরের চিত্র হচ্ছে-২০২১ প্রতিবেদনে রেড জোনে ছিল ১৩টি সূচক। এছাড়া ২০২০ সালে ১২টি, ২০১৯ সালে ১১টি, ২০১৮ সালে ৭টি এবং ২০১৭ সালে ছিল ১০টি সূচক। এর আগে ২০১৬, ২০১৫ এবং ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে ছিল ৯টি করে সূচক। ২০১৩ ও ২০১২ সালের প্রতিবেদনে রেড জোনে ছিল ১০টি করে সূচক।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা তো প্রতিনিয়তই দেখছি রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ হচ্ছে। বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক দমনপীড়ন চলছে। এরই প্রতিফলন ঘটেছে আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে। এ ধরনের প্রতিবেদন সরকারকে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
ইআরডি সূত্র জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ড গঠন করে এবং এটি পরিচালনার জন্য ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি)। ফান্ড গঠনের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। এমসিএফ’র আওতায় স্টেট ডিপার্টমেন্ট দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচিত দেশগুলোকে সহায়তা করে থাকে। এর একটি হচ্ছে থ্রেসহোল্ড কান্ট্রি বা কম অঙ্কের সহায়তার দেশ। এই প্রোগ্রামের আওতায় সাধারণত ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যটি হচ্ছে কমপ্যাক্ট অর্থাৎ বড় অঙ্কের সহায়তা। এর আওতায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান দেওয়া হয়। এই ফান্ডের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যুক্ত করতে প্রতিবছর বৈঠক করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি)। কোনো দেশকে মূল্যায়নের জন্য প্রথমদিকে ১৭টি নির্দেশক থাকলেও সর্বশেষ ২০১২ সালে নতুন নির্দেশকসহ মোট ২০টি নির্দেশক যুক্ত করা হয়। ওই বছরই প্রথমবারের মতো মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করেন। তখন ওই ফান্ডে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তাকে অনুরোধ জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে অংশ নিয়েছিল সরকারের প্রতিনিধিও। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিবছর বাংলাদেশের পার্টনারশিপ ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। এর মধ্যে এমসিএফ’র বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে টেকনিক্যাল টিম পাঠাতে বলেছিল। কিন্তু টেকনিক্যাল টিম পাঠানো হলেও চ্যালেঞ্জ ফান্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আর এগোয়নি।
সূত্র: যুগান্তর