মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারিয়ে কানাডার পর আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনেক চেষ্টার পরও ঢুকতে না পেরে অবশেষে ডিপোর্টি (ফেরত) প্যাসেঞ্জার হিসেবে দেশেই ফিরতে হয়েছে ডা: মুরাদ হাসানকে। গতকাল বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন আলোচিত-সমালোচিত সদ্য সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী। এ সময় তাকে দেখতে বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে নানা পেশার (যাত্রীসহ) উৎসুক মানুষ ভিড় করেন। কেউ কেউ তাকে দেখে টিপ্পনিও কাটে। অনেকে হাসাহাসিও করে। তবে বিমানবন্দরে অবস্থানকালে বেশির ভাগ সময় তিনি মুখে মাস্ক লাগিয়ে রাখেন। তার পরনে ছিল জিন্সের প্যান্ট, ছাই কালারের মাথা ঢাকাসহ ফুল-হাতা গেঞ্জি। পায়ে ছিল কালো রঙের জুতা। গলায় ঝোলানো হলুদ হাতব্যাগ। আর সাথে ছিল লাল ট্রাভেল ট্রলি ব্যাগ।
বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যেহেতু তিনি ডিপোর্টি প্যাসেঞ্জার, তাই তাকে ইমিগ্রেশনে মুচলেকা দিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তিনি ইমিগ্রেশনের হেফাজত থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে অনেকটা চুপিসারে বের হয়ে যান।
এর আগে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের একজন কর্মকর্তা একটি গণমাধ্যমের কাছে নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘ফ্লাইটে থাকা রিফিউজড প্যাসেঞ্জারদের এমিরেটস এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ওই তালিকায় ওনাকেও (মুরাদ) হস্তান্তর করা হয়েছে। উনি এখন বিমানবন্দরেই আছেন।’
বিমানবন্দরের অন্য এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, মুরাদ হাসান কানাডা গেলেও তার দুবাই প্রবেশে ভিসা ছিল না। তিনি দুবাইয়ের ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার ছিলেন। ভিসা না থাকলে দুবাই ইমিগ্রেশন তাকে এন্ট্রি দেয়ার কথা নয়। তাই তাকে ডিপোর্টি প্যাসেঞ্জার হিসেবে অন্য যাত্রীদের সাথে ফিরতি ফ্লাইটে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী বিদেশ থেকে যেসব যাত্রীকে ফিরতি ফ্লাইটে ফেরত পাঠানো হয় তাদের ঢাকার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ইমিগ্রেশনের কাছে লিখিত মুচলেকা দিলে তখন তাকে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।
কেন এবং কী কারণে ডাক্তার মুরাদ হাসান কানাডা থেকে ফেরত এসেছেন তা জানতে গতকাল সন্ধ্যার পর তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে সাংবাদিকরা বারবার ফোন দেয়ার পরও তিনি রিসিভ করেননি। তার পরিবার কিংবা সংশ্লিষ্ট কারো কোনো বক্তব্যও জানা সম্ভব হয়নি। এর আগে গতকাল সকালের ফ্লাইটে ডা: মুরাদ দেশে ফিরছেন এমন খবরে সাংবাদিকরা তখন বিমানবন্দরে অবস্থান নিয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা ভ্যাকসিনের দুই ডোজ টিকার সনদ না থাকার কারণে মুরাদ হাসান কানাডা ও দুবাইয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তিনি ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট ও করোনা প্রটোকল না মেনে কিভাবে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজে উঠলেন?
গত বৃহস্পতিবার রাতে ডা: মুরাদ কানাডার টরেন্টোর উদ্দেশে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। কানাডার পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পরই ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা তার কূটনৈতিক পাসপোর্টে এন্ট্রি না দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আলাদা করে ফেলেন। সেখানে তাকে কানাডা আগমনের কারণসহ নানা বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ডা: মুরাদ হাসানের কাছ থেকে কোনো সন্তোষজনক বক্তব্য না পেয়ে তাকে ঢাকাগামী এমিরেটস এয়ারলাইন্সের অপর একটি ফ্লাইটে তুলে দেয়।
মুহূর্তে তার কানাডায় প্রবেশ করতে না পারার সংবাদ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। নানা জল্পনাকল্পনার মধ্যে খবর আসে, মুরাদ হাসান এমিরেটসের অপর একটি ফ্লাইটে কানাডা থেকে দুবাই বিমানবন্দরে ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে অবস্থান করছেন।
সেখানে থেকে দুবাই ইমিগ্রেশনে যান। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ভিসা না থাকায় তাকে এন্ট্রি দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এমন কথা শোনার পরই তিনি আরো ভেঙে পড়েন। এরপর তিনি দেশটিতে থাকা তার শুভ্যানুধায়ী, দুবাইয়ের কনসাল জেনারেল অফিস ও ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ফোনে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোথাও থেকে তিনি পাচ্ছিলেন না সুসংবাদ। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করতে গিয়ে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। পরে তিনি শনিবার মধ্যরাতে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে উঠে ঢাকার পথে ফেরত আসছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেই খবরের সূত্র ধরে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ওই ফ্লাইটটি রোববার সকাল ৮টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা। কিন্তু বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ডা: মুরাদ নির্ধারিত ওই ফ্লাইটে উঠেননি। তাহলে ডা: মুরাদ কোথায় গেলেন? এমন জল্পনাকল্পনার মধ্যে রোববার বিকেলে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের অপর একটি ফ্লাইটে তিনি ঢাকায় অবতরণ করেন এবং ইমিগ্রেশনের সার্বিক বিষয় শেষ করে চুপিসারে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের পদ হারালেও ডা: মুরাদ হাসান এখনো সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল রয়েছেন।
টেলিফোনে এক চিত্রনায়িকাকে অশালীন মন্তব্য এবং ধর্ষণের হুমকি দেয়ার অডিও ফাঁস হওয়ার পর গত সোমবার মুরাদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর থেকে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার চেষ্টা করেন। একদিন পর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলে তা গৃহীত হয়। একই দিনে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগ তাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। বুধবার মুরাদের কোনো খোঁজ ছিল না। ব্যক্তিগত ফোনও বন্ধ রাখেন। তবে বৃহস্পতিবার রাতে তিনি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজির হন। তখন জানাজানি হয় তিনি কানাডার উদ্দেশে দেশ ছাড়তে যাচ্ছেন।
এরপর দুই দফা সময় পিছিয়ে মধ্যরাতে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি ঢাকা ছাড়ে। কিন্তু টরেন্টোর পিয়ারসন বিমানবন্দরে তাকে আটকে দেয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে বলে প্রবাসী একজন সাংবাদিক তার অনলাইনে মিডিয়ায় সংবাদ পরিবেশন করেন। সেখানে তিনি লেখেন, সংসদ সদস্য ডা: মুরাদ হাসানকে কানাডায় ঢুকতে দেয়নি দেশটির বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি। টরেন্টোর পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তথ্য প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে মুরাদ হাসান কয়েকবার কানাডা সফর করেন। সর্বশেষ তিনি গত সেপ্টেম্বরেই ওই দেশে এক সপ্তাহ ছিলেন। এবার কানাডায় যাতে মুরাদকে ঢুকতে না দেয়া হয় সেজন্য প্রবাসীদের একটি অংশ সক্রিয় ছিল। তার বিরুদ্ধে সেখানকার অপর একটি অংশ মানববন্ধন ও কুশপুত্তলিকা পোড়ায়।
তবে একটি অনলাইন নিউজপোর্টাল ঢাকার কানাডীয় হাইকমিশনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ডা: মুরাদ হাসানের যেসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকার কথা ছিল তার কাছে তা ছিল না। এজন্য তাকে বিমানবন্দরে আটকে দেয়া হয়। টিকার সনদ ও কোভিড নমুনা পরীক্ষা ছাড়া তাহলে ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মুরাদ কিভাবে পার করলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো: মাহাবুব আলী সাংবাদিকদের জানান, ‘বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য বিভাগের পৃথক ডেস্ক রয়েছে। টিকার সনদের বিষয়টি তারা পরীক্ষা করে থাকে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ তাদের বসার জায়গা করে দিয়েছে মাত্র।’ এ বিষয়ে জানতে হলে স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
জামালপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়ার রহমান তালুকদারের ছেলে মুরাদ হাসান ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ি) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভায় প্রথমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুরাদকে। পাঁচ মাস পর তাকে সরিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নাতনী জাইমা রহমানকে নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে সমালোচনায় পড়েন ডা: মুরাদ হাসান। এর কয়েক দিনের মধ্যে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সাথে তার অশালীন কথাবার্তার একটি অডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়েও মুরাদের অশালীন বক্তব্যের অডিও ছড়িয়ে পড়ে। এসব কারণে তাকে মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ গত রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র দাবি করেছে, তিনি তার নিজ সংসদীয় এলাকা জামালপুরে যাননি।
সূত্র: নয়াদিগন্ত