বোরো ধান উৎপাদনে নতুন রেকর্ডের বছর চলছে। সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্যের মজুদ। চলছে আমনের ভরা মৌসুম। তবুও বাড়ছে চালের দাম। কিন্তু কেন বাড়ছে, এর কোনো সদুত্তর নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী দীর্ঘদিনের। দায় চলে আসে চাতাল বা মিল মালিকদের ওপর। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে যথাযথ বাজার মনিটরিং নেই সংশ্লিষ্টদের। তারা কেবল হুঁশিয়ারি দিয়েই দায় সারছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশ আসে বোরো থেকে। দেশে চাল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আমন। ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে যখন বোরো চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে এক কোটি ৯৫ লাখ ৭৬ হাজার, দুই কোটি তিন লাখ ৮৯ হাজার এবং দুই কোটি এক লাখ ৮১ হাজার টন, তখন ওই সব অর্থবছরে আমন চালের উৎপাদন দাঁড়িয়েছিল যথাক্রমে এক কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার, এক কোটি ৪০ লাখ ৫৫ হাজার এবং এক কোটি ৫৫ লাখ টন (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২১)। লক্ষ্যমাত্রার (৫৫.৭৭ লাখ হেক্টর) চেয়ে বেশি পরিমাণ (৫৬.২০ লাখ হেক্টর) জমিতে আমনের চাষ হওয়ায় এবং বড় রকমের বন্যা না দেখা দেয়ায় এবার আমন চাল উৎপাদনের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা (১.৫৬ কোটি টন) ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে সরকারিভাবে বলা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছর বোরোর উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ১১ লাখ টনেরও বেশি হয়েছে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৯৬ লাখ টন। চলতি বছর বোরোতে দুই কোটি পাঁচ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। হয়েছে দুই কোটি সাত লাখ ৮৪ হাজার ৫০৮ টন। চলছে আমন মৌসুম। কৃষি বিভাগ বলছে আমনের এবার ভালো ফলন হয়েছে। এর বাইরে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। বর্তমানে সরকারের গুদামে ১৭.১৩ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। এর মধ্যে চাল ১৩.৯১ লাখ টন ও গম ৩.১৬ লাখ টন। ফলে দেশে ধান-চালের কোনো সঙ্কট নেই। তবুও বাজারে কমছে না চালের দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার ধান কিনতে থাকলে চালের দাম এর চেয়ে কমবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। কেউ কারসাজি করে চালের দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখীই থেকে যাচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) নিত্যপণ্যের বাজারদরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চিকন চালের দাম ৫৮ থেকে ৬৮ টাকা কেজি, মাঝারি ৫০ থেকে ৫৬ টাকা এবং মোটা চাল স্বর্ণা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি। চলতি বছরে বোরো ধানের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু বোরোর ভরা মৌসুমেও চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বর্তমানে আমনের ভরা মৌসুমে বাজার ঊর্ধ্বমুখী। গত বোরো ধানের মৌসুমে চালের দর বাড়তি থাকায় সরকার বাধ্য হয়ে গত আগস্টে চালের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। পাশাপাশি পণ্যটি আমদানিতে সব ধরনের নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্কও প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তারপরও বাজারে চালের দাম কমেনি।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। কেউ কারসাজি করে চালের দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। বর্তমানে সরকারের গুদামে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। ফলে দেশে ধান-চালের কোনো সঙ্কট নেই।
তবে কেউ কেউ বলছেন, ধান-চালের উৎপাদন ও বিপণনে তথ্যের গরমিল রয়েছে। এই কথাটি অবশ্য খোদ কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরাও একাধিকবার বলেছেন। চালের দাম ঊর্ধ্বমুখীর পেছনে চাতাল মালিক ও ব্যবসায়ীদের ওপর দায় এলেও উৎপাদন ও বিপণন তথ্যের গরমিলও অন্যতম কারণ বলেই মনে করা হয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল সম্প্রতি একটি পত্রিকার কলামে উল্লেখ করেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, চালের দামবৃদ্ধির পেছনে অন্য কারণ রয়েছে। সরকার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে চাল সংগ্রহে পুরোপুরি চালকল মালিকদের ওপর নির্ভরশীল। সরকার চলতি আমন মৌসুমে তিন লাখ টন ধান এবং পাঁচ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা চালের আকারে সাত লাখ টনের কিছুটা বেশিতে দাঁড়াবে। এর পুরোটাই সরবরাহ করবেন চালকল মালিকরা। সরকারকে চাল সরবরাহ ছাড়া তারা ধান কাটা-মাড়াই মৌসুম শেষে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে লাভের অঙ্ক বাড়াতে মৌসুম চলাকালে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে প্রচুর ধান কিনে মজুদ করে। এ কাজে তাদের বেশি করে উৎসাহিত করে থাকতে পারে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের আবির্ভাব। তিনি আরো বলেন, আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার প্রায় ৪০টি দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এর সংক্রমণ ঘটেছে। বাংলাদেশও ওমিক্রনের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে হয় না। ওমিক্রনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলেছে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা। এতে বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে ধান-চাল মজুদ করছেন বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন, যা বিশেষ করে চালের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে।
চালের দাম প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, বর্তমানে সরকারের গুদামে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তায় এই মজুদ বৃদ্ধি করতে সরকার সচেষ্ট। তিনি বলেন, কেউ যেন অবৈধ মজুদ করে খাদ্যের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো কারণ ছাড়া চালের দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্র: নয়াদিগন্ত