আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানামুখী বিতর্ক থাকায় পুনর্গঠনের লক্ষ্যে নানা পক্ষের দাবিকে আমলে নেওয়া হয়। এ পরিপ্র্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিতে তাদের সঙ্গে গত ২০ ডিসেম্বর সংলাপ শুরু করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তবে সব দল সংলাপে অংশ নিচ্ছে না। এ তালিকায় রয়েছে বিএনপি, বামগণতান্ত্রিক জোট, বাসদ গণফোরাম ও ইসলামী আন্দোলন। এদিকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, ক্ষমতাসীন চৌদ্দ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলসহ (জাসদ-ইনু) ৭টি রাজনৈতিক দলের ৬টি দল সংলাপে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ সংলাপকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে অংশ নেয়নি। তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ বা প্রস্তাবনা দিয়েছে।
সংলাপে অংশ নেওয়া ৬টি রাজনৈতিক দলই ইসি পুনর্গঠনে আইন করার পাশাপাশি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিরপেক্ষ ইসি গঠনের প্রস্তাব করেছে। এদিকে ৩ থেকে ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংলাপের দ্বিতীয় ধাপে নতুন করে আরও ৫টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর মধ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সংলাপে যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। একইভাবে মোস্তফা মহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরাম ও সর্বশেষ ইসলামী আন্দোলন সংলাপে যাবে না বলে তাদের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। এর বাইরেও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগই ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের পক্ষে। তবে আইন প্রণয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করেন, আইন প্রণয়নের মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে নেই। ইসি পুনর্গঠনে আইন প্রণয়নের বিষয়ে সরাসরি নাকচ না করলেও এ সময়ের মধ্যে আইন সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী। এমন বাস্তবতায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সব রাজনৈতিক দলকে সংলাপ সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এই অল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যে সংলাপ শুরু করেছেন। এর মধ্যে যেহেতু সংসদ আইন করতে পারবে না, আগে যে পদ্ধতিতে হয়েছে, সেই নিয়মে হতে পারে, অথবা ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি রয়েছে। এ কমিটি নির্বাচন কমিশনের জন্য ১০ জনকে নির্বাচন করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারেন। সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নাম পাঠাতে পারে। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এবারই আইনটা হতো, মহামারীর কারণে সম্ভব হয়নি, এবার না হলে আগামীবার হবে। সার্চ কমিটি গঠন, যেটা এবার হচ্ছে, গতবারও হয়েছে, সেটাও আইনের বাইরে নয়, নিয়মের বাইরে নয়, সংবিধানের বাইরে নয়।’
অন্যদিকে সংলাপকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে চলছে বাহাস। সংলাপে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে আমন্ত্রণ পায়নি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আমন্ত্রণ পেলেও বিএনপি সংলাপে অংশ নেবে না এমনটা জানিয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এই সংলাপ অর্থহীন। এই সংলাপ দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারবে না।’ জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি সংলাপে আসবে না, এটা গণতন্ত্রের জন্য খারাপ খবর। তবে সংলাপে না এলেও বিএনপি নির্বাচনে আসবে, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হলেও নির্বাচনে আসবে।’
কেবল আইওয়াশ এবং আনুষ্ঠানিকতা- এমন ধারণা থেকে সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোস্তফা মহসীন মন্টু নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। আগামী ৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলেও শনিবার দুপুরে রাজধানীর পল্টনে তাদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে করে ‘না’ জানিয়ে দিয়েছে ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাইর পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। তিনি নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানান।
রেজাউল করীম বলেন, ‘২০১২ ও ২০১৭ সালের সংলাপে অংশ নিয়ে আমরা চরমভাবে হতাশ হয়েছি। ২০১২ সালের সংলাপে গঠিত ইসি ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করেছে, যেখানে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হয়েছেন। আর ২০১৭ সালের সংলাপের পর গঠিত কমিশন একটি চরম বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেছে, যাকে অনেকেই মধ্যরাতের নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করে।’
নির্বাচন কমিশনকে রাষ্ট্রপতির জবাবদিহিতার আওতায় না আনায় হতাশ প্রকাশ করে মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি কোনো রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেননি। তা ছাড়া অতীতের দুটি সংলাপে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে রাষ্ট্রপতির কাছে আমাদের গঠনমূলক প্রস্তাবগুলোর কোনোটাই মূল্যায়ন করা হয়নি। যে দল তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করেছে, তিনি সেই দলের স্বার্থের বাইরে যেতে পারেননি।’
সংলাপের শুরুর দিন ২০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ ৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেয়। সংলাপে তারা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আইন প্রণয়নের কথা বলেছে। দলের নেতারা জানান, এ প্রস্তাবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইন প্রণয়নের জন্য যথেষ্ট সময় হাতে নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাপা বলেছে, সংসদে এ বিষয়ে বিল উত্থাপন করা হলে তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। সময় স্বল্পতার কারণে যদি সংসদে আইন প্রণয়ন সম্ভব না হয়, তা হলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইন বলবৎ করতে পারেন। পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে তা বিল আকারে পাস করার জন্য জাপা সহযোগিতা করবে। যদি কোনো কারণে অধ্যাদেশ জারি সম্ভব না হয় এবং পূর্বের ন্যায় সার্চ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য চারজনের নাম প্রস্তাব করেছে জাপা।
২২ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় সংলাপে অংশ নেয় জাসদ। তারাও ইসি পুনর্গঠনে আইনের প্রস্তাব করেছে। ২৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর সঙ্গে মতবিনিময় হয়। পরদিন ২৭ ডিসেম্বর তরিকত ফেডারেশনের সঙ্গে বিকাল ৪টায় এবং খেলাফত মজলিসের সঙ্গে সন্ধ্যা ৬টায় সংলাপ হয়। পরদিন ২৯ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে সন্ধ্যা ৬টায় সংলাপ হয়। সব দলই ইসি গঠনে আইনের প্রস্তাব করেছে।
আগামীকাল ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় ক্ষমতাসীন চৌদ্দ দলের অন্তর্র্ভুক্ত দল গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি সন্ধ্যা ৭টা ও সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল ও সন্ধ্যা ৭টায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংলাপের আমন্ত্রণ পেয়েছে। তবে কমিউনিস্ট পার্টি সংলাপে অংশ নেবে না জানিয়ে দিয়েছে।
এ ছাড়া গণতন্ত্র পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল সংলাপে ইসি গঠনে আইনের প্রস্তাব দেবে বলে জানা গেছে। সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘ইসিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য আমাদের দাবি থাকবে। আমাদের দাবিগুলোর মধ্যে আইন প্রণয়ন অন্যতম। তা ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার বা অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-ই যেন থাকেন এ প্রস্তাবও থাকবে।’
গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ইসি গঠনে আইন করা গেল না এটা দুঃখজনক। এর জন্য শুধু যে সরকার দায়ী তা নয়। আমাদের দলেরও অনেক সংসদ সদস্য ছিল, তারাও এ দাবি উত্থাপন করেনি। এখন দাবি উঠেছে। সুতরাং আমরাও সংলাপে এ প্রস্তাব দেব।
সূত্র: ্আমাদের সময়.কম