নানা সহিংসতার মধ্যদিয়ে শেষ হলো পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। এ দিন দেশের বিভিন্ন জেলায় নির্বাচনী সংঘাতে এখন পর্যন্ত সাত জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চাঁদপুরে দুইজন, চট্টগ্রামে একজন, জামালপুরে একজন, গাইবান্ধায় একজন, মানিকগঞ্জে একজন ও বগুড়ায় একজন রয়েছেন।
চাঁদপুরে দুইজনের মৃত্যু: নির্বাচনী সহিংসতায় চাঁদপুরের কচুয়ার ও হাইমচরে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলা পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ বুধবার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কচুয়ার সাচার এলাকায় নিহত যুবকের নাম শরীফ হোসেন। তার বাবার নাম শহীদ উল্লাহ। দুই ইউপি সদস্য প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিলে ছুরিকাঘাতের শিকার হন তিনি। হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয় শরীফের।
আরেক ঘটনায় হাইমচরের নীলকমল ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাহেরচরে বিকেল সাড়ে ৩টায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী-সমর্থকদের সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে আরেকজন মারা গেছেন। তার নাম-পরিচয় এখনও জানা যায়নি। তিনি পার্শ্ববর্তী শরীয়তপুরের বাসিন্দা বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
হাইমচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব মোল্লা বলেন, নীলকমল ইউনিয়নে একজন মারা গেছেন। তবে তার নাম-পরিচয় এখনো জানা যায়নি। তদন্তে কাজ করছে পুলিশ।
চট্রগ্রামে একজনের মৃত্যু: চট্টগ্রামের আনোয়ারায় দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে অংকুর দত্ত (৩০) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। বুধবার বেলা ১২টায় চাতরী ইউনিয়নের সিংহরা গ্রামে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি বাংলাদেশ জার্নালকে নিশ্চিত করেন আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম শিকদার। নিহত অংকুর দত্ত সিংহরা গ্রামের নেপাল দত্তের ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, সিংহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে প্রায় দু’শ গজ দূরে বর্তমান মেম্বার রঘুনাথ শিকদার ও অপর প্রার্থী নাজিম উদ্দীনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে অংকুর নামের এক যুবক আহত হয়। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
জামালপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবকের মৃত্যু: জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নে নির্বাচনী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে আল আমীন (২২) নামের এক যুবক মারা গেছেন। তার স্বজন সাকিব মিয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিহত আলআমিন মেরুর চরের বাঘাডুবা গ্রামের আচ্ছা মিয়ার ছেলে। তিনি আনারস প্রতীকের সতন্ত্র প্রার্থী মনোয়ার হোসেনের সমর্থক।
বুধবার দুপুরের দিকে মেরুরচর ইউনিয়নের মেরুরচর হাছেন আলী উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক আল আমীন গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় আহত হন পুলিশসহ আরও ৯ জন।
সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া কর্মী-সমর্থকদের দেয়া আগুনে পুলিশের একটি পিকআপ ও তিনটি মোটরসাইকেল পুড়ে গেছে। এছাড়াও আনসারদের বহন করা একটি গাড়ি ভাঙচুর করে উত্তেজিত লোকজন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশি অ্যাকশনের সময় আহত হয়েছে চারজন সাধারণ লোক। এ সময় প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর কর্মীদের আঘাতে আহত হয়েছেন পাঁচ পুলিশ সদস্য। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে পুলিশ। প্রার্থীর কর্মীদের ছোড়া পাল্টা গুলিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় ভোটকেন্দ্রসহ আশপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ভোটারসহ আহত সাধারণ মানুষ দৌড়ে পালিয়ে যায়।
আহতরা হলেন, বকশীগঞ্জ থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম সম্রাট, ওসি (তদন্ত) আব্দুর রহিম, কনস্টেবল আব্দুল আলিম (৪০), মো. শাহজাহান (৫৫), আ. মজিদ (৫৭) ও আনসার সদস্য আব্দুল আলিম (২৫)। আহত সাধারণ লোকদের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
ওসি মো. শফিকুল ইসলাম সম্রাট বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এ সময় লাঠিসোটা ও ইটপাটকেল নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া লোকজনের আঘাতে ৫ পুলিশ ও এক আনসার সদস্য আহত হন। উত্তেজিত কর্মীরা গুলি ছুড়লে পুলিশও ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। তবে আল আমীন পুলিশের গুলিতে মারা যাননি।
গাইবান্ধায় গলাকেটে হত্যা: গাইবান্ধার সাঘাটায় নির্বাচন চলাকালীন সময়ে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় আবু তাহের (৩২) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তাকে ধারালো হাসুয়া দিয়ে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বুধবার ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে উপজেলার জুমারবাড়ী ইউনিয়নের জুমারবাড়ী আদর্শ ডগ্রি কলেজ কেন্দ্রের বাইরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আবু তাহের জুমারবাড়ি গ্রামের ওমর আলীর ছেলে।
স্থানীয়রা জানায়, ভোট চলাকালীন বিকেল পৌনে ৩টার দিকে কেন্দ্রের বাইরে মেম্বার প্রার্থী আইজল মিয়ার (টিউবওয়েল) সমর্থক আবু তাহেরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বি মেম্বার প্রার্থী রাসেল আহমেদের (পাখা) কর্মী-সমর্থকদের কথা-কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে আবু তাহেরকে একা পেয়ে রাসেলের কর্মী-সমর্থকরা ধারালো হাসুয়া দিয়ে তার গলা কেটে ফেলে। গুরুতর আহত রাসেলকে উদ্ধার করে সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পথে মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আলমগীর। তিনি জানান, কেন্দ্রের বাহিরে এই সংঘর্ষ হওয়ায় নির্বাচনী ফলাফলে এর কোন প্রভাব পড়বে না। সংঘর্ষের এ ঘটনায় ফৌজদারি অপরাধে মামলা করা হবে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
মানিকগঞ্জে সংঘর্ষের কবলে পড়ে হার্ট অ্যাটাকে নারীর মৃত্যু: মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বাচামারা ইউনিয়নের বাচামারা ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সহিংসতায় ছলেমন খাতুন (৫০) নামে এক নারী নিহত হয়েছেন। বুধবার দুপুরে উপজেলার বাচামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ওই নারীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, নিহত ছলেমন খাতুন উপজেলার বাচামারা গ্রামের খোরশেদ আলমের স্ত্রী। তিনি দুপুরে ভোট দিতে বাচামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে যান। এ সময় ৫ নং ওয়ার্ডের দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পরে এ ঘটনা দেখে ছলেমন খাতুন হার্ট অ্যাটাক করেন।
দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরুল হাসান বলেন, বাচামারা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডে দুই সদস্য প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই নারী ভোট দিতে কেন্দ্রে আসেন। সংঘর্ষের কবলে পড়ে তিনি হার্ট অ্যাটাক করেন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলে তিনি মারা যান।
বগুড়ায় যুবককে কুপিয়ে হত্যা: বগুড়ার গাবতলী উপজেলার রামেশ্বরপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলাকালীন সময়ে দুই ইউপি সদস্য (মেম্বার) প্রার্থীর মধ্যে বিরোধের জের ধরে জাকির হোসেন (৩৫) নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বুধবার দুপুরের দিকে উপজেলার জাইগুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাহিরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত জাকির হোসেন জাইগুলি উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত লয়া মিয়ার ছেলে। তিনি ইউপি সদস্য প্রার্থী সাইদুল ইসলামের (টিউবওয়েল প্রতীক) সমর্থক হিসেবে কাজ করছিলেন।
স্থানীয়রা জানায়, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে উপজেলার জাইগুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের উৎসাহিত করার কাজ করছিলেন সাইদুল ইসলামের টিউবওয়েল প্রতীকের কর্মী সমর্থকরা। এ সময় অপর ইউপি সদস্য (মেম্বার) প্রার্থী মিঠু মিয়ার (ফুটবল প্রতীক) কর্মী সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে জাকির হোসেনকে প্রতিপক্ষের লোকজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ৩টার দিকে জাকির হোসেনের মৃত্যু হয়।
গাবতলী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জিয়া লতিফুল ইসলাম বলেন, ইউপি সদস্য (মেম্বার) প্রার্থীদের মধ্যে বিরোধের জের ধরে ভোট কেন্দ্রের বাইরে এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নিহতের লাশ উদ্ধার করে মর্গে রাখা হয়েছে, মামলা প্রক্রিয়াধীন।
সূত্রঃ বাংলাদেশ জার্নাল