ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধিঃ
ময়মনসিংহের ভালুকা পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাঁঠালী এলাকায় অবস্থিত আনোয়ার হোসেনের অবৈধ করাতকল থেকে বিপুর পরিমাণ অবৈধ গজারি কাঁঠ উদ্ধার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) বিকালে ভালুকা মডেল থানা এসআই কাজল ও হাজির বাজার বিট অফিসার মকবুল হোসেন উপস্থিত থেকে ৩/৪ টি গাছের ১১টি গজারির গাছের টুকরা উদ্ধার করে বিট অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ভালুকার গণ মাধ্যমকর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে করাতকলের মালিক আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এসময় সাংবাদিকরা ৯৯৯ কল করে আইনি সহযোগীতা নেন এবং ভালুকা বিট ও রেঞ্জারকে অবহিত করা হয়।
আনোয়ারের কাছে করাতকলের বৈধতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বৈধতার প্রশ্নে অনেক সাংবাদিককে পূর্বেও অবহিত করেছি, আপনারা কিসের সাংবাদিক? আপনাদের গজারি গাছ, ও লাইসেন্স নিয়ে কথা বলার কোন অধিকার নেই বলে নানা বাজে মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, এসিল্যান্ডের কাছ থেকে প্রত্যায়ন নিয়ে করাতকল চালাচ্ছেন। পরে সাংবাদিকরা করাতকল মালিক আনোয়ারের এসব অসৌজন্যমূলক আচরণের কথা ভালুকা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে অবহিত করেন। এ সময় করাতকল মালিক আনোয়ার হোসেনের সহযোগী কাঁঠ ব্যাবসায়ী সাবেক মেম্বার মুনজু ও মাসুদ মিয়া সাংবাদিকদের সাথে অশুভ আচরণের তীব্র নিন্দা জানান এবং আনোয়ারের করাতকল লাইসেন্সবিহন বলে মন্তব্য করেন।
জানাযায়, ভালুকা উপজেলার ৮৯টি করাতকলের মধ্যে ৭৭টির নেই কোনো বৈধ কাগজপত্র ও অনুমোদন। পৌরসভায় লাইসেন্সকৃত ১২টি করাতকল রয়েছে। সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমোদন ছাড়াই চলছে অন্যান্য অবৈধ এসব করাত কল। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারে মধ্যে গড়ে ওঠা ৭ ডজন করাতকল উজার হচ্ছে বনজ সম্পদ।
এদিকে অননুমোদিত করাতকলের কারণে প্রতি বছর সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। কারও মতে আনাচে কানাচে রয়েছে প্রায় শতাদিক করাত কল।
ভালুকা বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার পৌরসভায় যথাযথ প্রক্রিয়ায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত করাতকলের সংখ্যা মাত্র ১২টি। অপরদিকে লাইসেন্সবিহীন পরিচালিত ৭৭টি। এরমধ্যে লাইসেন্স পেতে আবেদন করছে প্রায় ৪০টি এবং মামলা চলমান রয়েছে প্রায় ১৫ টির বিরোদ্দে।
বন বিভাগের আইন অনুযায়ি, বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও এই এলাকার মধ্যে রয়েছে শতাদিক করাতকল। সংরক্ষিত সামাজিক বনায়নের বন ঘেঁষে, এমনকি বন কর্মকর্তাদের কার্যালয়ের কাছেই স্থাপন করা হয়েছে অবৈধ করাতকল।
জানা যায়, সংরিক্ষত বন থেকে চোরাই পথে আনা বিভিন্ন গাছ অবাধে চেড়াই ও বিক্রি হচ্ছে এসব করাতকলে। বন উজারের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। এতে হুমকির মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
করাতকল ( লাইসেন্স) বিধিমালা ২০১২ (৭খ) তে বলা আছে, কোনো সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিনোদন পার্ক, উদ্যান এবং জনস্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে এমন স্থান থেকে কমপক্ষে ২০০ মিটার মধ্যে করাতকল স্থাপন করা যাবে না। উক্ত আইনের (৭ক) তে সরকারি বনভূমির সীমানা থেকে কমপক্ষে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে এটা নিষিদ্ধ। অথচ এই নিদের্শনা মানছে না কেউ। বিধি-বহির্ভূতভাবে যত্রতত্র বসানো হয়েছে এসব অবৈধ করাতকল।
একাধিক করাতকল মালিক জানান, শিল্প কারখানার কাঠ কাটার সূত্র ধরেই করাতকলের ব্যবসা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স করা হয়। কোনো সময় ওপর থেকে কেউ এলে তাদেরকে ম্যানেজ করা হয়।
অপরদিকে অনুমতিপ্রাপ্ত করাতকল মালিকদের অভিযোগ, অবৈধ করাতকলগুলো দেদার চলার কারণে তাদের কলগুলো ভালোভাবে চলছে না। তারা আরো বলেন, বনাঞ্চলের ১০কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন না করার সরকারি বিধান থাকলেও স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে স্থানীয় লোকজন বনাঞ্চলে গড়ে তুলেছেন ওইসব অবৈধ করাতকল।
সরেজমিনে স্থানীয়দের অভিযোগ, রেঞ্জ অফিস ও বিট অফিসের নাকের ডগায় মালিকরা করাতকল স্থাপন করে দিন-রাত চোরাই কাঠ চিরাই করছে। এসব করাতকল ও অতিরিক্ত গাছ চুরির কারণে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকার বাগান ধংস হয়ে যাচ্ছে। করাতকলের বিরুদ্ধে অভিযান না থাকায় সংরক্ষিত বাগান বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে। অনুমোদনহীন এসব অবৈধ করাতকলের মাধ্যমে বেপরোয়াভাবে চলছে বৃক্ষ নিধন।
ভালুকার সুশীল সমাজ জানিয়েছেন, শিঘ্রই আমরা মানববন্ধন করব বন ও পরিবেশ রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। অবৈধ করাতকলে প্রকাশ্যে বনের গাছ চিড়াই ও পাচার হচ্ছে। এতে পরিরেশের ভারসাম্য নষ্ট ও মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
ভালুকা বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ মহিউদ্দিন অবৈধ করাতকলের কথা স্বীকার করে বলেন, যেহেতু আনোয়ার হোসেনের করাতকলের লাইসেন্স নেই এবং গজারি গাছ পাওয়া গেছে এ ব্যাপারে আইনি ব্যাবস্থা নেয়া হবে। এসব অবৈধ করাত কলের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। যারা অবৈধ ভাবে চালাচ্ছে তাদেরকে ইতিমধ্যে নোটিশ দেয়া হয়ছে। অনেকে লাইসেন্স পেতে অবেদন করছে। বাকিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে করাতকল স্থাপনের সঙ্গে আমি কিংবা আমার বিট অফিসারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
উথুরা বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ হারুনুর রশিদ খাঁন অবৈধ করাতকলের কথা স্বীকার করে বলেন, উথুরা রেঞ্জে ৪১ টি করাতকল রয়েছে। এসব অবৈধ করাতকলের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে বিভাগীয় প্রধানের বরাবর উচ্ছেদ মামলা করা হয়েছে। যারা অবৈধ ভাবে চালাচ্ছে তাদেরকে ইতিমধ্যে নোটিশ দেয়া হয়েছে।
ভালুকা সহকারী কমিশনার ভূমি ভালুকা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল বাকিউল বারী জানান, শিঘ্রই উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলে অবৈধ করাতকলের ব্যাপারে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা খাতুন জানান, অবৈধ করাতকলের ব্যাপারে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।