ব্যাপক উৎসবমুখর পরিবেশে গতকাল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন পর ভোটাররা কোনো রকম সংঘাত-সহিংসতা ছাড়াই প্রয়োগ করেছেন ভোটাধিকার। কোথাও ছিল না সহিংসতা ও অনিয়মের অভিযোগ। অনেক প্রবীণ ও নবীন ভোটার বললেন, ‘এমন পরিবেশে ভোট দিতে পেরে আমরা আনন্দিত।’ নারী ভোটারের ছিল উপচে পড়া ভিড়। এমনকি বিকাল ৪টায় ভোটের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলেও অনেক কেন্দ্রে ছিল দীর্ঘ লাইন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন সবাই। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা এ নির্বাচনকে বাংলাদেশের ভোটের সংস্কৃতিতে ইতিবাচকভাবে ফেরা বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বললেন, এমন পরিবেশই সব ভোটে কাম্য।
নারায়ণগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, সারা দেশে আগ্রহ সৃষ্টি করা এ নির্বাচনে দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর লড়াই নিয়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করলেও ভোটের দিন গতকাল ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও তা সহিংসতার পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
সোয়া ৫ লাখ ভোটারের ভোট গ্রহণের সময় ছিল সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা। সরেজমিনে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই কেন্দ্রগুলোর সামনে ভোটারদের উপস্থিতি দেখা গেছে। সকাল পৌনে ৮টায় মহানগরের ২০ নম্বর বাবুরাইল বেপারীপাড়া বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে বুথের সামনে অন্তত ৩০ জন পুরুষ ভোটারকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। একই সময় পাশের ২১ নম্বর বাবুরাইল বেপারীপাড়া বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বুথের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন অন্তত ২৫ জন নারী ভোটার। এ সময় জোবায়দা আখতার নামে একজন নারী ভোটার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সকাল সকাল ভোট দিয়ে গিয়ে রান্নাবান্না করব তাই আগেই এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি।’
সকাল সাড়ে ৯টায় পশ্চিম দেওভোগের শিশুবাগ স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে নারী ও পুরুষের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। এ কেন্দ্রে নারী ও তরুণ ভোটারের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোট দিতে আসা নারী ভোটার টেপী রানী চক্রবর্তী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগে দেওভোগে থাকতাম তাই ভোট দেওভোগেই উঠেছে। এখন আমরা বন্দরে থাকি। কিন্তু ভোট দিতে নদী পার হয়ে এখানে এসেছি।’
ভোট দিয়ে বেরিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নামে নতুন এক ভোটার বলেন, ‘এটি আমার জীবনের প্রথম ভোট। খুবই ভালো লাগছে। প্রথমবারই ইভিএমে ভোট দিলাম।’
এ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার মুসকান হিজড়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি ভোটার হওয়ার পর প্রথমবার ভোট দিতে এলাম। আমার খুব ভালো লাগছে। এখানকার ভোটের পরিবেশ খুব ভালো। ইভিএমে কীভাবে ভোট দিতে হয় তা শিখে এসেছি। আমি দোয়া করি নৌকার জয় হোক। আমি আইভী আপাকে ভোট দেব।’ এ স্কুলে নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক দুটি কেন্দ্র করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৬৮ আর পুরুষ কেন্দ্রে ২ হাজার ৪৯।
এ ছাড়া দেওভোগের মর্গান স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র, চাষাঢ়া কলেজ রোড এলাকার তুলারাম কলেজ কেন্দ্র, মাসদাইর এলাকার আদর্শ স্কুল কেন্দ্র, খানপুরের নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি স্কুল কেন্দ্র, সিদ্ধিরগঞ্জের ধনকুন্ডা স্কুল কেন্দ্র, মিজমিজির পাইনাদি ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা কেন্দ্র, শিমরাইলে ডিএনসি মাদরাসা নারী ভোট কেন্দ্র ঘুরে উৎসবমুখর ভোটের চিত্র দেখা গেছে। প্রতিটি কেন্দ্রেই ভোট গ্রহণের বুথের সামনে ভোটারের দীর্ঘ লাইন।
পাঁচ বছর ধরে সমালোচনাবিদ্ধ কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের জন্য এ নির্বাচন ছিল শেষটা ‘ভালো’ করার চ্যালেঞ্জ। আবার জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর রাজধানীর পাশের এ নগরে নির্বাচন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নারায়ণগঞ্জ ঘুরে যাওয়া নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘এ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষ ও সংঘাত ঘটেনি। বিগত পাঁচ বছরে যতগুলো সিটি নির্বাচন হয়েছে, আমার বিবেচনায় আমাদের আমলের প্রথম কুমিল্লা সিটি নির্বাচন ও সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন সর্বোত্তম।’
ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর ঢাকায় নির্বাচন কমিশন সবিচালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। এখন পর্যন্ত এ নির্বাচন নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবরও পাওয়া যায়নি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চেয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে কম ভোট পড়লেও ভোটারের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল বলে দাবি করেন ইসি সচিব।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার বলছেন, কোথাও বেশি, কোথাও কম ভোট পড়েছে। সকালের দিকে কয়েকটি কেন্দ্রে ধীরগতি দেখা গেছে। কোথাও কোনো মেশিন ডিস্টার্ব করেছে, সাময়িক কিছু সমস্যা ঘটলেও টেকনিক্যাল পারসনরা দ্রুত সেরে নিয়েছেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল ভোট গ্রহণের সময়। কোনো গোলযোগ নেই। উৎসবমুখর ভোট হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। দিন শেষে ভোটার উপস্থিতি বেশ ভালো।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর ভূমিকার কারণেই নারায়ণগঞ্জে শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। ভোটের আগে থেকেই ভোট-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
ইভিএমে ধীরগতি : ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের গতি সকাল থেকেই ধীর হয়ে গিয়েছিল। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ না হওয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর মেলাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সময় নষ্ট হয়েছে। ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে নারীরা বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন। বয়স্ক নারীদের অনেকেরই ফিঙ্গারপ্রিন্টে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। মিজমিজি পাইনাদি ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ফয়জুর রহমান বলেন, নারীরা ইভিএমে অভ্যস্ত নন। তাদের সবকিছু শিখিয়ে দিতে হচ্ছে। ভোটারের অধিকাংশই বয়স্ক হওয়ায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেতে ঝামেলা হচ্ছে। দফায় দফায় চেষ্টার পর ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলানো যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডে পুরুষ কেন্দ্রের বাইরে তেমন ভিড় না থাকলেও নারীরা দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেড় থেকে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে বুথে ঢুকতে পারেননি বলে অভিযোগ নারী ভোটারদের। আবার ভোটার নম্বরের সঙ্গে ভোটারকক্ষ নম্বর খুঁজতে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে অনেক নারী ভোটারকে। রুনা আক্তার নামে এক নারী ভোটার বলেন, ‘দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর কক্ষের কাছে গিয়ে শুনি আমার ভোট অন্য কক্ষে। সেখানে যাওয়ার পর বলে নিচের কক্ষে যেতে।’ এমন অনেক নারী ভোটার বিভিন্ন অভিযোগ করেন।
ভোট গ্রহণ চলাকালেই বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও হাতি প্রতীকের তৈমূর আলম খন্দকার ইভিএমে ধীরগতি নিয়ে অভিযোগ করেছেন। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার যখন কেন্দ্র পরিদর্শনে যান তখন ভোটাররাও তাঁর কাছে ধীরগতির বিষয়ে অভিযোগ জানান।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারের দাবি, নারায়ণগঞ্জে মক ভোটিংয়ের সময় নারী ভোটাররা সেভাবে অংশ নেননি। ফলে নির্বাচনের দিন তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে ইভিএম সম্পর্কে বোঝাতে সময় লেগেছে প্রিসাইডিং অফিসারের। এতে ভোট নিতে একটু সময় বেশি লেগেছে। অবশ্য লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে ভোট দিতে দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক- ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম : ভোট গ্রহণ চলাকালে নির্বাচন পর্যবেক্ষক ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের পক্ষ থেকে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জে শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে। ফোরামের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবেদ আলী বলেন, ‘আশঙ্কা ছিল গোলযোগ হতে পারে। কিন্তু সকাল থেকে ৮১টি কেন্দ্র পরিদর্শন করে আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। কোথাও কোনো গোলযোগ দেখতে পাইনি।’ তিনি জানান, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ওই পর্যবেক্ষক সংস্থায় পর্যবেক্ষক হিসেবে ছয়টি সংস্থা কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, আসক ফাউন্ডেশন, বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য সংস্থা।
সংখ্যায় নারায়ণগঞ্জ সিটি ভোট : ৭২.৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে মোট সাধারণ ওয়ার্ড ২৭টি। সঙ্গে রয়েছে ৯টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড। গতকালের সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয়েছে ১৯২ কেন্দ্রে। বুথ ছিল ১ হাজার ৩৩৩টি। মোট ভোটার ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন। পুরুষ ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৬ আর মহিলা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫১১। কেন্দ্রের নিরাপত্তাসহ ভোটের দিন পুলিশের ২৭টি স্ট্রাইকিং ফোর্স ও ৬৪ মোবাইল টিম মাঠে ছিল। তিনটি এলাকা মিলিয়ে ১৪ প্লাটুন বিজিবি, ছয়টি চেকপোস্ট, সাতটি টহল টিম দায়িত্ব পালন করেছে। এ ছাড়া সাধারণ কেন্দ্রে ১৫ ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৬ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করেন।
সূত্রঃ বিডি প্রতিদিন