শামীম সুমন, মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা:
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। হঠাৎ এক দুর্ঘটনা কবলে পড়ে সব পাল্টে যায়। চাকরি চলে যাওয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। বাড়ির পাশে বাজারে শুরু করেন ব্যবসা। সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। পরে শুরু করেন মৌমাছি পালন ও মধু আহরণ। তাতেই তাঁর জীবনের চাকা গেছে ঘুরে।টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বানাইল ইউনিয়নের বাঙ্গলা গ্রামের বাসিন্দা দেওয়ান হাসান আবদুল্লাহর।
শর্ষে ফুলের খেত থেকে তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে মৌমাছির মাধ্যমে মধু আহরণে ব্যস্ত। কখনো বাক্সে ভরা মৌমাছির তদারকি করছেন। আবার কখনো খাঁচার মধ্যে থাকা কাঠের ফ্রেম থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে মধু আহরণ করছেন। গত মঙ্গলবার উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের শুভুল্যা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর অধীনে পাঁচজন শ্রমিক কাজ করছেন।
১৯৯৬ সালে মির্জাপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর নানাভাবে কাটে প্রায় পাঁচ বছর। ঢাকার মুগদা এলাকায় একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেনএক বন্ধুর সহায়তায় । বাড়তি আয়ের আশায় পাশাপাশি দোকান চালু করেন। সেখান থেকে যাত্রাবাড়ীতে অন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। এভাবে কেটে যায় দীর্ঘ ১২ বছর।
একদিন বাথরুমে পা পিছলে ডান পায়ের গোড়ালির রগ ছিঁড়ে যায়। এতেই তাঁর জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। শিক্ষকতার চাকরি চলে যায়। বন্ধ হয় ব্যবসা। সুস্থ হয়ে গ্রামে ফেরেন। বাড়ির পাশের উপজেলার বাঙ্গলা বাজারে মাত্র ২০ হাজার টাকা নিয়ে এক দোকানে তিনি ওষুধ, গ্যাসের সিলিন্ডার ও মোবাইলে টাকা দেওয়ার ব্যবসা শুরু করেন। সে ব্যবসা করে তাঁর সংসার চলছিল না। ছয় বছর পর তিনি ব্যবসা ছেড়ে মধুপুরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি নেন। কিন্তু সেখানে বেতন না পেয়ে আবার গ্রামে ফেরেন। বাড়ি ফিরে পুরোনো দোকান চালানো চেষ্টা করলেন কিন্তু লাভ হয়নি। বাড়িতে তখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।
তিন বছর আগে তিনি তাঁর এক আত্মীয়কে দেখে মৌমাছি পালনের আগ্রহী হন। প্রথমে তিনি টাঙ্গাইলের বিসিক থেকে ছয় মাসব্যাপী হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেন। গত বছরের অক্টোবরে তিনি মধুপুরে মধু সংগ্রহের কাজ করেন। এক মাস আগে শুভুল্যা আসেন। অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে দেড় শতাধিক বাক্সে লাখো মৌমাছি পালন করছেন। খামারে এ পর্যন্ত তাঁর প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। চলতি মৌসুমের (প্রায় আট সপ্তাহ) জন্য শুভুল্যাতে চার হাজার টাকায় জমি ভাড়া নিয়েছেন। বর্তমানে সপ্তাহে প্রায় পাঁচ মণ মধু সংগ্রহ করেন। ৪০০-৫০০ টাকা কেজি দরে সে মধু বিক্রি করেন। প্রয়োজনীয় ব্যয় আর শ্রমিকের মজুরি বাদে যে টাকা থাকে, তাতে সংসার ভালোভাবে চলছে।
কথা হয় নেত্রকোনা থেকে আসা শাহ আলমের সাথে সে দেওয়ান হাসানের সাথে ব্যবসা ও মৌমাছির দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন আমরা সরিষার মৌসুম শেষ হলে এখান থেকে আবার রাজশাহী চলে যাব। সেখানকার এক আম বাগানের মালিকের সাথে কথা হয়েছে।
মধু কিনতে আসা উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের দেওহাটা বাজারের মো.মাহাবুব হাসান বলেন, কেনার পাশাপাশি মধু উৎপাদন দেখার সুযোগ পেয়ে তাঁর ভালো লেগেছে।
শুভূল্যা গ্রামের মো.তোজাম্মেল তালুকদার টিটু বলেন, নিজ গ্রামে প্রাকৃতিক উপায়ে মধু আহরণ করা হয়। যা খাঁটি। এ জন্য তিনি বারবার এ মধু কিনতে আসেন।
দেওয়ান হাসান আব্দুল্লাহ বলেন, মৌমাছি চাষে অনেক পরিশ্রম। মূলধনও লাগে বেশি। এ কাজে যাঁরা জড়িত, তাঁদের সরকারি প্রণোদনা দেওয়া উচিত। তাহলে অনেকে এ কাজে আগ্রহী হবেন।
মির্জাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার পাল বলেন, শর্ষে ফুলের মৌসুমে মৌমাছি চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।আর মৌমাছি চাষের ফলে শর্ষের ফলনও অনেক গুন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে প্রান্তিক মৌমাছি চাষিদের জন্য বিতরনের সুব্যবস্থা করা হবে।
মৌমাছি পালন ও মধু আহরণ করে চলছে দেওয়ান হাসানের সংসার
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন: