১৯৭১ সাল। রোজার মাসের ঘটনা। ১৫-বছর বয়সী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারাগারে বন্দী। ২৭ রমজানের ইফতারের পর তিনি বসে ছিলেন, এমন সময় কারাগারের দরজা বেশ আওয়াজ করে খুলে গেল।
দরজা খোলার সাথে সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ভেতরে প্রবেশ করলেন। তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন আলী রেজা।
“সে আমাদের বললো যে কাম আউটসাইড (বাইরে এসো) এবং লাইনআপ (সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াও)। লাইনআপ করার পরে তিনি আমাদের আঙ্গুল তুলেতুলে বললেন যে এ কয়জন একদিকে থাকো, এবং এই কয়জন আরেক দিকে থাকো। ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আলাদা করলো এবং আমরা চারজন আলাদা,” এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
আজ তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তিন বছর আগের এই দিনে (২২ জানুয়ারি) না ফেরার দেশে পাড়ি জমান সঙ্গীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
২০১৪ সালের জুন মাসে ‘বিবিসির সাথে গানগল্প’ অনুষ্ঠানে নিজের জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সেখানে যুদ্ধকালীন অবস্থার কথা তুলে ধরেন তিনি
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ার, নাম সাদ উল্লাহ।
ব্রিগেডিয়ার সাদ উল্লাহর কাছে গিয়ে কিশোর বুলবুল জানতে চাইলেন, “কেন তাদের আলাদা করা হচ্ছে?”
“তখন সে আমাকে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলালো কিছুক্ষণ। বললো যে তোমরা তো সাতদিন পরে ধরা পড়েছিলে। ওদের মৃত্যুদণ্ড আজ কার্যকর করবো আর তোমাদেরটা কার্যকর করবো আর তিনদিন পর। সরাসরি বললো। আমি ওনাকে থ্যাংকস দিলাম। ঐ রাতটা আমি আমার জীবন থেকে কখনো ভুলতে পারবো না। অনেক হৃদয় বিদারক একটা বিষয়,” বলছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
প্রতি রাতে জেলখানা থেকে তাদের নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে অত্যাচার করা হতো। ওই রাতে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এবং তার আরো কয়েকজন সহযোদ্ধা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
“আমরা চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই করেছি এবং ঐ অবস্থায় আমরা পালিয়ে গেছি,” জানান বুলবুল।
সংগীত জগতে বুলবুলের উত্থান
১৯৭০’এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেশাত্মবোধক গান দিয়ে সুরকার হিসেবে যাত্রা শুরু করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তবে তিনি নিজে কখনো গায়ক হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেননি।
“আমার স্বপ্ন ছিল যে আমি গান লিখবো। যিনি গান গান, তিনি গান গাইবেন। আমি একাধারে গান লিখবো, গান সুর করবো - এমন দুঃস্বপ্ন কখনো দেখিনি,” এভাবেই নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন তিনি।
‘নয়নের আলো’ সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে আসেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ওই সিনেমার ছয়টি গানই তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি তাকে।
কিন্তু নয়নের আলো সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার কাজ পেতে যথেষ্ঠ বেগ পেতে হয়েছিল আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে।
“এ ছবিটি পাওয়ার যে প্রচেষ্টা আমার, সে কী বলবো? হিমালয় পর্বতের চূড়ায় উঠা আর এই ছবির কাজ পাওয়া একই কথা,” জানিয়েছিলেন তিনি।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের হাতের রেখা দেখে একজন জ্যোতিষী মন্তব্য করেছিলেন, এ হাতের মধ্যে সুরকার এবং গীতিকার হওয়ার কোন রেখাই নেই - সাক্ষাৎকারে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
কিন্তু জ্যোতিষীর সেই ভবিষ্যতবাণী ভুল প্রমাণ করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। পরবর্তীতে তিনি হয়ে ওঠেন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সুরকার ও গীতিকার।
বাংলাদেশের কয়েকশ’ সিনেমায় তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। আর এসব গান দর্শকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
এক সময় তার সুর করা গানগুলো ছিল শ্রোতা-দর্শকদের মুখে-মুখে।তার লেখা এবং সুরকরা অনেক জনপ্রিয় গানের শিল্পী ছিলেন রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, অ্যান্ড্রু কিশোর, খালিদ হাসান মিলু, কনকচাঁপা এবং সামিনা চৌধুরী।
‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বৌ সাজিয়ে’, ‘আম্মাজান আম্মাজান’, ‘ঘুমিয়ে থাকো গো সজনী’, ‘চিঠি লিখেছে বউ আমার’, ‘জাগো বাংলাদেশ জাগো’ - এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা গানের সুর করেছেন তিনি।
সূত্র: সমকাল