চীনের আগ্রাসী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ইউরোপের দুই ক্ষুদ্র দেশ লিথুয়ানিয়া ও স্লোভেনিয়া। স্বায়ত্ত্বশাসিত তাইওয়ানে তারা প্রতিনিধি স্থাপনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে ইউরোপী ইউনিয়নভূক্ত ছোট্ট দুটি দেশের ‘সাহস’ খুব কাছ থেকেই দেখছে বিশ্ব।
লিথুয়ানিয়া এবং স্লোভেনিয়া ন্যাটো জোটের সদস্য। চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েই তারা যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র তাইওয়ানে প্রতিনিধি অফিস খোলার কথা জানিয়েছে। তাদের এই উদ্যোগে ক্ষুব্ধ এবং রাগান্বিত চীন। বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিকের আগ মুহূর্তে স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানেজ জানসা তার এই পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেছেন, চার থেকে পাঁচবার তিনি তাইওয়ানে ভ্রমণ করেছেন। নিজেদের ভবিষ্যত নির্ধারণের অধিকার তাইওয়ানের জনগণের রয়েছে। তাইওয়ান একটি গণতান্ত্রিক দেশ যা আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মান ও আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করে। এক সাক্ষাৎকারে তার এই বক্তব্য নিয়ে কূটনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে।
কূটনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট না হলেও প্রধানমন্ত্রী জানেজ জানসা স্পষ্টভাবে বলেছেন, স্লোভেনিয়া এবং তাইওয়ান প্রতিনিধি বিনিময়ে কাজ করছে। এটি দূতাবাস পর্যায়ের নয়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের মতো একই পর্যায়ের হবে।
তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে স্লোভেনিয়ার এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ বেইজিং। গত বছর লিথুয়ানিয়ার একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। স্লোভেনিয়ার সঙ্গে লিথুয়ানিয়ার ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। লিথুয়ানিয়ার পদক্ষেপ অনুসরণ করে চীনের ভূ-কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে স্লোভেনিয়া। দেশটি তাইওয়ানে প্রতিনিধি অফিস খোলার ঘোষণা দিয়েছে।
স্লোভেনিয়া ও তাইওয়ান সম্পর্ক শক্তিশালীকরণে কাজ করছে। তবে স্লোভেনিয়ার এই পদক্ষেপের ব্যাপক সমালোচনা করেছে চীন। কারণ দেশটি তাইওয়ানকে নিজেদের বলে দাবি করে। তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ঘোষণা স্লোভেনিয়া এমন সময়ে দিয়েছে,যখন বেইজিং তাইওয়ান দখল করতে কূটনৈতিক চাপ তৈরি করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক সংশোধনের আশা সত্ত্বেও তাইওয়ানে স্লোভানিয়ার অফিস খোলার পরিকল্পনা আরেকটি কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে।
স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে একে বিপজ্জনক বিবৃতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান। তিনি বলেছেন, স্লোভেনিয়ার এই পদক্ষেপের চীন হতবাক। এটি স্পষ্টভাবে এক-চীন নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে।
ঝাও আক্ষরিক অর্থেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় চীনা জনগণের দৃঢ় সংকল্প, ইচ্ছা এবং ক্ষমতাকে কেউ অবমূল্যায়ন করবে না।
তাইওয়ানের আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ এবং স্লোভেনিয়ার মধ্যে প্রতিনিধি অফিস নেই। অস্ট্রিয়ার তাইপেই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি অফিস বর্তমানে স্লোভেনিয়া সম্পর্কিত বিষয়গুলো পরিচালনা করে।
স্লোভেনিয়ার পদক্ষেপে চীন কী প্রতিক্রিয়া জানাবে সেই বিষয়টি নিয়ে চীনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্বের বিশ্লেষকরা। স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানসা লিথুয়ানিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বলপ্রয়োগের জন্য বেইজিংয়ের কঠোর সমালোচনা করেছেন। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্কের বিষয়ে অস্পষ্ট হওয়ায় চীনকে নিয়ে উপহাস করেছেন। তিনি বলেছেন, চীন তাইওয়ানের সঙ্গে যখন ব্যবসা করছিল, তখন অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাইওয়ানের একই সম্পর্ক থাকায় তার বিরোধিতা করছিল।
চীনা বিশেষজ্ঞ ঝাও লিজিয়ান স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানেজ জানসার বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ইউরোপে অখ্যাত এবং দুর্নীতির অভিযোগের মুখে জানসা তার সমস্যাযুক্ত চেহারা ঢাকতে চীন-ইইউ সম্পর্ককে জটিল করার বিনিময়ে তাইওয়ান কার্ড খেলছে।
আরেকজন বলছেন, লিথুয়ানিয়ার মতো স্লোভেনিয়া তাইওয়ান বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তার কণ্ঠস্বর তুলে ধরে নিজের রাজনৈতিক উপস্থিতি বাড়াতে চায়।
চীনের আরেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, লিথুয়ানিয়ান এবং স্লোভেনিয়ান রাজনীতিবিদরা চীনের প্রতি ইইউ’র বিদ্যমান অবিশ্বাসকে কাজে লাগাচ্ছে।
স্লোভেনিয়ার বিরুদ্ধে চীনের সম্ভাব্য পদক্ষেপ বুঝতে হলে লিথুয়ানিয়ার বিরুদ্ধে চীন কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা দেখতে হবে। চীন কেবল লিথুয়ানিয়ার আমদানির ওপরই ব্যবস্থা নেয়নি, লিথুয়ানিয়ার সাপ্লাই চেইন ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইডেনের মতো ইইউ দেশগুলোর পণ্যের ওপরও ব্যবস্থা নিয়েছে।
বেইজিং দাবি করেছে, তাইওয়ানের প্রতি লিথুয়ানিয়ার অবস্থান ইইউর এক চীন নীতি লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু লিথুয়ানিয়া যে নীতি লঙ্ঘন করেছে ভিলনিয়াস এবং ব্রাসেলস উভয়ই কঠোরভাবে তা অস্বীকার করেছে।
প্রাপ্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনের শুল্ক নীতিতে লিথুয়ানিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। লিথুয়ানিয়ার মূল ভূখণ্ডে উৎপাদিত পণ্যগুলো চীনের বন্দরে ঢুকতে পারে না। ইউরোপীয় দেশ ফ্রান্স, জার্মানি এবং সুইডেনের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারণ এসব দেশের পণ্যের কিছু অংশ লিথুয়ানিয়ার তৈরি। এখন দেখার বিষয় স্লোভেনিয়ার বিরুদ্ধে চীন কী পদক্ষেপ নেয়। ইইউ নেতারা চীনের ওপর এ ব্যাপারে কড়া নজর রাখছেন।
সূত্র : সিঙ্গাপুর পোস্ট