একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। চলতি মাসে ছয়বার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে দেশটি। তবে জাপান এবার ততটা আমলে নিচ্ছে না। কারণ উত্তর কোরিয়ার এবারের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মূলত স্বল্পপাল্লার। সেগুলো এখন পড়ছে দেশটির কাছাকাছি সাগরে, জাপানের উপকূল থেকে অনেক দূরে।
এর আগে ২০১৭ সালের অগাস্টেও এ রকম দফায় দফায় মিসাইল ছুড়ে যাচ্ছিল উত্তর কোরিয়া। সেসব দিনে এয়ার রেইড সাইরেনের তীব্র শব্দে জাপানিদের ঘুম ভাঙতো। কোনো ধরনের আগাম ঘোষণা ছাড়া যে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উত্তর কোরিয়া ছুড়তো, সেগুলো জাপানের মাথার উপর দিয়ে গিয়ে পড়ত প্রশান্ত মহাসাগরে। ফলে জাপানের মাথাব্যথার কারণ ছিল বৈকি।
এক প্রতিবেদনে বিবিসি লিখেছে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন নিজেকে খানিকটা সংযত রেখেছেন। তবে যে ফল তিনি চাইছেন, সেটা না পেলে এই সংযম হয়তো থাকবে না।
আসলে কী চাইছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইদানিং যে পরীক্ষাগুলো উত্তর কোরিয়া চালাচ্ছে, তার লক্ষ্য হলো পূর্ণ শক্তির এবং কার্যকর একটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও টেক্কা দিতে পারবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক কিম ডং ইউপ বলছেন, ‘আমরা এখন অবাক হচ্ছি, কারণ আমরা আগে উত্তর কোরিয়ার প্রযুক্তিকে খাটো করে দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, তারা তো এমনিতেই দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, উত্তর কোরিয়া তাদের সামরিক সক্ষমতা এগিয়ে নিচ্ছে আমাদের ধারণার চেয়ে দ্রুত গতিতে।’
গত ৫ ও ১০ জানুয়ারি দুটি পরীক্ষার পর পিয়ংইয়ং দাবি করে, তারা হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকেল এবং ম্যানুভারেবল রি-এন্ট্রি ভেহিকেলের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু এসব পরীক্ষার গুরুত্ব কী?
বিবিসি লিখেছে, এসব পরীক্ষার মানে হলো উত্তর কোরিয়া এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে চাইছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের উপকূলজুড়ে মোতায়েন করা ব্যয়বহুল ও জটিল মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমকেও ভেদ করতে পারবে।
সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরির বিশেষজ্ঞ দুয়েওন কিম বলেন, ‘এটা মোটামুটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, উত্তর কোরিয়া এমন মিসাইল সিস্টেম বানাতে চায়, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমও ঠেকাতে পারবে না।’
তার সঙ্গে একমত অধ্যাপক কিম ডং ইউপ। তার ভাষায়, উত্তর কোরিয়া এমন একটি সমরাস্ত্র বানাতে চায় যেটা কাজ করবে কাঁকড়াবিছার লেজের মতো করে। কাঁকড়াবিছা বা বৃশ্চিক তার লেজের বিষাক্ত হুল দিয়ে নিজের আত্মরক্ষার পাশাপাশি শত্রুকে ঘায়েল করতে পারে।
অধ্যাপক কিমের মতে, কোনো দেশকে আক্রামণ করা হয়ত উত্তর কোরিয়ার প্রথম উদ্দেশ্য নয়, তারা সম্ভবত নিজেদের প্রতিরক্ষার দিকটি আগে দেখতে চায়। সেজন্য নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা তারা বাড়াতে চাইছে।
দক্ষিণ কোরিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র যদি আক্রমণ করে, তাহলে তা ঠেকানোর মত সামর্থ্য উত্তর কোরিয়ার প্রথাগত সমরাস্ত্রগুলোর নেই। অবশ্য সেখানে আক্রমণ করার কোনো আগ্রহও যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণ কোরিয়া এখনো দেখায়নি।
তাহলে কেন ওই দারিদ্র্যপীড়িত ক্ষুদ্র দেশটির জিডিপির এক চতুর্থাংশ সামরিক শক্তি বাড়াতে খরচ করছেন কিম জং-উন?
ইন্টারন্যাশনাল পিসের কার্নেগি স্কলার আতিক পাণ্ডা মনে করেন, ‘এর একটি কারণ হতে পারে যে বাইরের বিশ্ব যাই মনে করুক, উত্তর কোরিয়া হয়তো ভাবছে, নিজেদের রক্ষা করার মত যথেষ্ট অস্ত্র তাদের হাতে নেই। কিম জং-উন হয়ত সে কারণে নিরাপত্তার শঙ্কায় ভুগছেন। আমার ধারণা, তিনি কাউকেই বিশ্বাস করেন না; এমনকি চীন বা রাশিয়াকেও না। আর সে কারণেই হয়তো তিনি সামরিক শক্তিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, যেটা হবে আমরা যাকে যথেষ্ট বলে ভাবতে পারি, তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী।’
আতিক পান্ডার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত নন দক্ষিণ কোরিয়ার ডংসেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রায়ান আর মায়ার্স। তার মতে, পারমাণবিক শক্তি আর ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার নিয়ে অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পিয়ংইয়ং।
তার ধারণা, কোরীয় উপদ্বীপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রত্যাহারে দক্ষিণ কোরিয়াকে রাজি করিয়ে একটি শান্তি চুক্তিতে আনতে চান উত্তরের নেতা কিম, আর সেজন্য হয়ত তিনি তার সামরিক শক্তির সুবিধা নিতে চাইছেন। আর তা করা সম্ভব হলে দক্ষিণ কোরিয়ার দখল নিতেও উত্তরের সামনে বাধা থাকবে না, হয়তো এটাই কিমের আশা।
আরও একটি স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যও পিয়ংইয়ংয়ের সামনে থাকতে পারে বলে কারও কারও ধারণা। উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি চালিয়ে নেওয়ার জন্য জাতিসংঘের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ওঠা দরকার। তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি আর মিসাইল ব্যবস্থার উন্নয়ন থামানোর জন্যই জাতিসংঘ ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। আর সেই নিষেধাজ্ঞা তুলতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে উত্তর কোরিয়াকে।
ইতিহাস বলছে, পিয়ংইয়ং যখনই ওয়াশিংটনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে, তখনই একটি সঙ্কট তারা তৈরি করেছে। উত্তর কোরিয়ার চলমান ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মধ্যে তেসনই একটি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। সেভাবে দেখলে বলতে হয়, এটা একভাবে ভালো লক্ষণ বলছেন দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক কিম ইয়ুংজুন।
তার ভাষায়, কিম জয়-উন হয়ত শান্তি আলোচনা শুরু করার আগে তার মিসাইল পরীক্ষা বাড়িয়ে যেতে থাকবেন, যাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনায় আসতে বাধ্য হন।
বিবিসি লিখেছে, যদি সত্যিই তাই হয়, কিম জং-উনকে হয়ত পুরোপুরি হতাশ হতে হবে। এর প্রথম কারণ, প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখন অন্য এক সঙ্কট নিয়ে দারুণ ব্যস্ত, আপাতত ইউক্রেইন নিয়েই তার মাথাব্যথা। দ্বিতীয়ত, উত্তর কোরিয়াকে ঠাণ্ডা করতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যতটা উৎসাহী ছিলেন, বাইডেন ততটা নন।
আতিক পাণ্ডার ভাষায়, নিজেদের কীভাবে আলোচনায় নিয়ে আসা যায় এবং আরও বেশি গুরুত্ব পাওয়া যায়, সেই কৌশল পিয়ংইয়ং ভালোই জানে। তবে জো বাইডেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে আসছেন। তার সঙ্গে বসে বাইডেনের রাজনৈতিক কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। সুতরাং বাইডেন হয়ত তখনই আগ্রহী হবেন, যদি এটা সত্যি সত্যি একটা বড় সঙ্কটের চেহারা নেয়।”
কেন এত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে উত্তর কোরিয়া?
২০১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর একটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। তার কয়েক মাস বাদে দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি দ্বীপে বোমাবর্ষণ করেছিল। এরপর ২০১৭ সালে দেখা গেল উত্তর কোরিয়া জাপানের ওপর দিয়ে দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে, এমনকি গুয়াম দ্বীপেও হামলার হুমকি দিচ্ছে। কিম জং-উন যদি সঙ্কটকে আরও বিপদজনক চেহারা দিতে চান, তাহলে সামনে দিনগুলোতে হয়ত সেরকম আরও কোনো ঘটনা দেখবে বিশ্ব।
আতিক পাণ্ডা বলেন, আমার মনে হয়, নতুন করে একটি সঙ্কট তৈরির সম্ভাবনা খুবই বাস্তব। উত্তর কোরিয়া সত্যিই চায়, যুক্তরাষ্ট্র তাদের গুরুত্ব দিক। দেশটা হয়ত ছোট, রিচার্ড নিক্সন একসময় বলেছিলেন চতুর্থ শ্রেণির বামন, কিন্তু এটা ঠিক যে এখন তাদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। তারা চায়, আমেরিকার একজন প্রেসিডেন্ট তাদের সেভাবেই দেখুক।
সূত্র: আমাদের সময়.কম