ভূমি নিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, মামলা-মোকদ্দমার মূল কারণ হিসেবে এ খাতের ২২টি অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূমিসংক্রান্ত এসব অপরাধ বন্ধে কঠোর শাস্তি ও জরিমানার বিধান রেখে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন-২০২১’ এর প্রাথমিক খসড়া চূড়ান্ত করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত আইনটির খসড়ায় মতামত দিতে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। মতামতের পর যথাযথ প্রক্রিয়া শেষে বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হবে। প্রস্তাবিত আইনটি কার্যকর হলে ভূমিসংক্রান্ত মামলা কমে যাবে এবং জনগণের ভোগান্তি ও হয়রানি দূর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রস্তাবিত আইনটির বিষয়ে গত ২০ জানুয়ারি ডিসি সম্মেলনের পর ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, অবৈধ ভূমি দখলকে ফৌজদারি অপরাধের আওতায় এনে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে এবং অন্যের সঙ্গে যোগসাজশে দলিল করে বা কোনো দলিল ছাড়াই অবৈধভাবে ভূমির দখল গ্রহণ বা দখল গ্রহণের চেষ্টা বা এর ক্ষতি রোধে আইনটি ভূমিকা রাখবে।
প্রস্তাবিত আইনটি কার্যকর হলে ভূমিসংক্রান্ত অপরাধ কমার পাশাপাশি মামলাও অনেক কমে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন) মুহাম্মদ সালেউদ্দীন। জানা গেছে, বর্তমানে ভূমি বিরোধের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মামলাই জমিজমা-সংক্রান্ত। গত জুন পর্যন্ত দেশের ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালগুলোয় বিচারাধীন মামলা ছিল ৩ লাখ ১৪ হাজার ৪০৯টি। এর মধ্যে পাঁচ বছরের ওপর বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ৮০৭টি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ১৯৩টি মামলার বিচার। অপর একটি সূত্র বলেছে-ফৌজদারি মামলার ৭০ শতাংশ মামলাই ভূমি সংশ্লিষ্ট।
ভূমির যেসব অপরাধ চিহ্নিত : প্রস্তাবিত আইনে ২২ ধরনের অপরাধ চিহ্নিত করে তার সাজা প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হলো-১. যদি ব্যক্তি মালিকানাধীন বা সরকারি খাস ভূমি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের জমির দলিল কেউ জাল করেন, তাহলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ২. যতটুকু জমির মালিকানা রয়েছে, কেউ যদি তার চেয়ে বেশি জমির দলিল করেন, তাহলে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড, তিন থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ৩. কোনো ব্যক্তি যদি মালিকানা ও দখলীয় জমির অতিরিক্ত জমি দলিল করেন, তাহলে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড, তিন থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ৪. কোনো ব্যক্তি যদি তার বিক্রীত জমি পুনরায় বিক্রি করার উদ্দেশ্যে দলিল করেন, তাহলে তার দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড, ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ৫. বিক্রয় চুক্তি বা বায়না চুক্তি করার পর অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে আবার চুক্তি করলে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড, ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ৬. ভুল বুঝিয়ে বা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা করে যদি কোনো ব্যক্তি অন্য আরেকজনের কাছ থেকে জমির দান দলিল করেন, তাহলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ৭. উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, অন্যকে বঞ্চিত করে নিজের হিস্যার চেয়ে বেশি জমি দলিল করা হলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ৮. উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, অন্যকে বঞ্চিত করে নিজের হিস্যার চেয়ে বেশি জমি বিক্রি করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হবে। ৯. বৈধ কাগজপত্র না থাকার পরও কেউ যদি ব্যক্তি মালিকানাধীন, সরকারি খাস ভূমি বা কোনো সংস্থার জমি জোর করে দখল করেন, সে জন্য এক বছর থেকে তিন বছরের কারাদন্ড, ১ থেকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ১০. কেউ যদি তার শরিক বা সহ-উত্তরাধিকারীর প্রাপ্য জমি জোর করে দখল করে রাখেন, সে জন্য ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ১১. অবৈধভাবে সরকারি-বেসরকারি ভূমি, নদীর পাড়, তলদেশ হতে মাটি বা বালু উত্তোলন করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ১২. বেআইনিভাবে মাটি ভরাট বা অন্য কোনোভাবে জলাবদ্ধতা তৈরি করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ১৩. বিনা অনুমতিতে ভূমির উপরের স্তর (টপ সয়েল) কেটে নিলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ১৪. অধিগ্রহণের আগে জমির মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত মূল্যে দলিল নিবন্ধন করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ১৫. জনসাধারণের ব্যবহার্য, ধর্মীয় বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করে অবকাঠামো নির্মাণ করা বা করতে সহায়তা করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ২ থেকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ১৬. বিনা অনুমতিতে পাহাড় বা টিলার পাদদেশে বসতি গড়লে যে কোনো সময় উচ্ছেদ করা যাবে। এ জন্য তিন মাসের কারাদন্ড অথবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে। ১৭. একই জমি একাধিক ব্যক্তির বরাবর দলিল করে দেওয়া, চুক্তি মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ে জমির দলিল দিতে না পারা, ফ্ল্যাট বিক্রয়ের পর ঘোষিত সময়ের মধ্যে হস্তান্তর করতে না পারা, ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হলেও দলিল দিতে ব্যর্থ হলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। ১৮. সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জমি ইত্যাদি বেআইনি দখল করে অবকাঠামো নির্মাণে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ১ থেকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। ১৯. মাটি, বালি বা আবর্জনা দ্বারা, অন্য কোনো পদার্থ বা উপায়ে বা অবকাঠামো নির্মাণ করে নদী, হাওর, বিল বা জলাভূমির আংশিক ক্ষতি করলে অনধিক এক বছরের কারাদন্ড, অনধিক ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। আর সম্পূর্ণ ক্ষতি হলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ১ থেকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। ২০. অবৈধ দখল গ্রহণ ও দখল বজায় রাখতে অস্ত্র প্রদর্শন, প্রাণনাশের হুমকি ইত্যাদি দেওয়া হলে ছয় মাস থেকে তিন বছরের কারাদন্ড, ১ থেকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। ২১. কেউ যদি সহ-মালিক বা পাশাপাশি থাকা জমির ক্ষতি করেন বা কোনো পরিবর্তন আনেন, তাহলে এক থেকে দুই বছরের কারাদন্ড, ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে এবং ২২. এই আইনের বর্ণনা করা যে কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে সেই ব্যক্তিরও অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তির মতো সাজা হবে। আইনের ২, ৩, ৪, ৫ ও ২০ নম্বর অপরাধ সংঘটিত হলে এটি জামিন অযোগ্য অপরাধ হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সূত্রঃ বিডি প্রতিদিন