ভোটের আগে দলগুলোর চেয়ে জোট আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দুই বছর বাকি থাকলেও রাজনীতিতে চলছে নানা মেরুকরণ। জোট গঠন ও দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে। ভোটের রাজনীতির সমীকরণ চলছে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ মিত্র বাড়াতে চাইছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতা হারা বিএনপি চায় নির্বাচনের আগে বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে। দুই দলের নীতিনির্ধারকরা এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে কাজ শুরু করেছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলছে জোট গঠনের তোড়জোড়। প্রধান দুই জোট তো আছেই, বেশ কয়েকটি ছোট ছোট জোটেরও জন্ম হচ্ছে। সবারই লক্ষ্য সংসদ নির্বাচন। এসব জোটের কেউ প্রধান দুই দলের পৃষ্ঠপোষকতা চায়, আবার কোনো কোনো জোট বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের জানান দিতে চায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায় জোট সম্প্রসারণ করে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সুদৃঢ় ঐক্য।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, ‘জোট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে। যারা দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বাস করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা মানে এমন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের ঐক্য হতে পারে।’
বিগত কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিশ্লেষণে দেখা যায়, জোটের রাজনীতিই ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করেছে। এই সময়ে জাতীয় পার্টি ও জামায়াত প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে সংসদের নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছিল দল দুটি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবি এখন সবার। এ ইস্যুতে আমরা বৃহত্তর ঐক্য গড়তে চাই। এরই মধ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোটের কয়েকটি দল এবং ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকেও বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। শিগগিরই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করব আমরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভোটের রাজনীতিতে এখন জোটের কদর বেশি। তাই রাজনৈতিক দলগুলো ছোট বড় দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করে নির্বাচনে অংশ নেয়। এ ক্ষেত্রে ছোট দলগুলোও প্রভাব ফেলতে পারে, তাই তাদেরও কদর বাড়ে। তিনি বলেন, এমন অনেক আসন আছে, যেখানে অল্প ভোটে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়। সেখানে জোটগত নির্বাচন হলে জোটভুক্ত দলগুলোর সমর্থকদের ভোটে প্রার্থী বিজয়ী হয়ে যান।
আওয়ামী লীগ : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন মিত্রের সন্ধান করছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন আছে, সারা দেশের কর্মী-সমর্থক রয়েছে এমন রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রাধান্য দেবে ক্ষমতাসীনরা। ক্ষমতাসীন দলটির নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট রয়েছে। এ জোটে ১৩টি রাজনৈতিক দল আছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট বাড়ানোর চিন্তা ভাবনা চলছে ক্ষমতাসীন দলে। এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে আলোচনা শুরু করেছেন কয়েকটি দলের সঙ্গে। বিশেষ করে নিবন্ধন থাকা বিএনপি জোট থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং বামপন্থি কয়েকটি দলের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হচ্ছে। মুক্তিযুুদ্ধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাগত জানাবে আওয়ামী লীগ। এ জন্য যেসব এলাকায় ওই রাজনৈতিক দলের ভোটব্যাংক আছে, সেখানে ছাড় দেওয়ার প্রস্তুতিও চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, শুধু ভোটের জন্য নয়, বরং দেশের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করছেন, তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে জোট গঠন করতে আগ্রহী ক্ষমতাসীনরা। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়, এমন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। তাই, গণতন্ত্রকামী এবং যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা মানে এমন দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেসব রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা স্বীকার করে এমন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গড়তে আমরা সব সময় প্রস্তুত। শুধু ভোটের জন্য জোট করতে হবে- এমন নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর জোট হওয়া প্রয়োজন। কারণ এই দেশে একটি গোষ্ঠী আছে, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় গাত্রদাহ হয়। এমন দলগুলোর বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে জোট গঠন করা প্রয়োজন।’ আওয়ামী লীগের সূত্র জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সঙ্গে জোট না হলেও দলটিকে আওয়ামী লীগ ছাড় দিয়েছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এমন ‘ব্যবহার’ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
বিএনপি : নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনে নামতে বিরোধী সব রাজনৈতিক দল সঙ্গে নিয়ে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়তে চায় বিএনপি। এ লক্ষ্যে শিগগিরই এসব দলের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করতে চায় দলটি। ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোকে সঙ্গে রেখেই চলছে বৃহৎ এই ঐক্য গঠনের তোড়জোড়। সাম্প্রতিক দলের স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দীর্ঘ সেই বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ছাড়া নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকে মতবিনিময়ের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্যকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে মতবিনিময়ের তারিখ নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মতবিনিময়ের পর রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি রূপরেখাও দেবে বিএনপি। জানা গেছে, বৃহত্তর ঐক্য গঠন ইস্যুতে ডান, বাম ও ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে ইতিমধ্যেই অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেছে বিএনপি। ঐক্যজোটে যেসব দল থাকছে : নির্বাচন এবং আন্দোলনের কৌশল ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্নে পরস্পরকে দায়ী করে আসছে ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোটের নেতারা। প্রায় বছর ধরেই এই দুই জোটকে নিষ্ক্রিয় রেখে নতুন ঐক্যজোট গঠনের আয়োজন করেছে বিএনপি। বৃহৎ ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে যেসব দলকে চায় বিএনপি সেগুলো হলো- বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীকে কৌশলে জোটের বাইরে রাখলেও ভিন্ন কৌশলে তাদেরও হাতে রাখবে বিএনপি।
যেভাবে তৈরি হচ্ছে আলোচনার ক্ষেত্র : বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, ঐক্যের আলোচনা চলছে দুই বছর ধরে। ধীরে ধীরে এ প্রক্রিয়া জোরদার হচ্ছে। গত ৩ জানুয়ারি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। দৃষ্টি ছিল রাষ্ট্রপতির সংলাপের দিকে। কারা যোগ দেন এবং কারা বর্জন করেন। ১৭ জানুয়ারি সংলাপ শেষ হলে শুরু হয় নতুন হিসাব। যারা সংলাপে অংশ নেননি তাদের সঙ্গে ফের যোগাযোগ করেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এরপরে লেখা শুরু হয় আমন্ত্রণপত্র। আর ঐক্যের প্রস্তাবের খসড়া চূড়ান্ত রাখা হয় আগেই। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি এখন আর শুধু বিএনপিরই নয়। এ দাবিতে সমগ্র জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ।
সূত্রঃ বিডি প্রতিদিন