পটুয়াখালীতে সরকারের নেওয়া একাধিক মেগা প্রকল্পের উন্নয়নের সঙ্গে পদ্মা সেতু চালু হলে বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র। একদিকে দক্ষিণাঞ্চলের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নসহ ব্যাপক উন্নয়ন, অন্যদিকে সারা দেশে ফেরিবিহীন যোগাযোগব্যবস্থা চালু হবে সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটার সঙ্গে। পরিবর্তন আসবে কৃষিতে। সরকারের হাতে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখে দক্ষিণাঞ্চলে ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা শত শত একর জমি কিনছেন। পায়রা বন্দর, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন, দৃষ্টিনন্দন ফোর লেনের পায়রা সেতুর পাশাপাশি শেরেবাংলা নৌঘাঁটি ও ইপিজেড স্থাপিত হলে পুরো দক্ষিণাঞ্চল পরিণত হবে অর্থনৈতিক জোনে। পায়রা সমুদ্রবন্দরের নিরাপত্তা এবং ব্লু-ইকোনমি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য কলাপাড়ার লালুয়ায় শেরেবাংলা নৌঘাঁটি স্থাপনে কাজ শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে সেকালের অবহেলিত দক্ষিণের জনপদ পটুয়াখালীর উন্নয়নের মহাসড়কে বাকি রইল শুধু রেলপথ ও গ্যাস। ব্যবসা-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনাময় দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। সারা দেশ থেকে পর্যটকদের কুয়াকাটায় আসতে কক্সবাজারের চেয়ে সময় কম লাগবে। ফলে পর্যটকদের আগমনে জমবে কুয়াকাটা। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা- এমনটাই মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। গত বছর ২৪ অক্টোবর পটুয়াখালী-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের সেতু লেবুখালীর পায়রা নদীর ওপর দৃষ্টিনন্দন ফোর লেন পায়রা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফোর লেন পায়রা সেতু চালুর ফলে মাওয়া থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ফেরিবিহীন যোগাযোগ শুরু হয়। লেবুখালীর পায়রা সেতুর উত্তর প্রান্তে স্থাপিত হয়েছে শেখ হাসিনা সেনানিবাস। দক্ষিণ প্রান্তে দুমকীতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। মহাসড়কের পাশে রয়েছে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। পায়রা সেতু থেকে মহাসড়কের আশপাশের এলাকায় শিল্প-কলকারখানা স্থাপনে জমি কেনার হিড়িক চলছে দেশের বড় বড় শিল্পমালিকদের। শহরের পাশেই স্থাপিত হয়েছে কোস্টগার্ড সিজি বেইজ অগ্রযাত্রা ঘাঁটি। পটুয়াখালী-কলাপাড়া মহাসড়ক থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত সাড়ে ৪ কিলোমিটার ফোর লেন সড়ক স্থাপন, মহাসড়ক থেকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত ছয় লেন মহাসড়কের কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের সদর উপজেলার আউলিয়াপুর এলাকায় ইপিজেড স্থাপনে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভূমি জরিপ করে অধিগ্রহণের জন্য ৪ ধারায় নোটিস দেওয়া হয়েছে জমির মালিকদের। কলাপাড়া থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে জমি কিনে সাইনবোর্ড বসিয়েছে বেশ কিছু কোম্পানি। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, ইপিজেড স্থাপনের জন্য পটুয়াখালীর সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের পচাকোড়ালিয়া মৌজায় ৪১০.৭৮ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ৪ ধারায় নোটিস দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের ক্লাবের (ইনভেস্টর ক্লাব) জন্য কুয়াকাটা মৌজায় ২.২৫ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।
জানা গেছে, পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার লেবুখালী পায়রা সেতু থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কের আশপাশে দেশের ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা জমি কিনতে শুরু করেছেন। মহাসড়কে গড়ে উঠেছে অটোরাইস মিল। ইতোমধ্যে জমি কিনেছেন বহু শিল্পমালিক। পায়রা বন্দর এলাকার আশপাশে জমি কিনেছে মদিনা গ্রুপ ও এমএম বিল্ডার্স নামের প্রতিষ্ঠান।
সাগরকন্যা কুয়াকাটায় ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল-মোটেল। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা, খাজুরা, গঙ্গামতী, কাউয়ার চর ও এর আশপাশে জমি কিনেছে সিকদার গ্রুপ, ইউএস বাংলা, সেঞ্চুরি, বসুধা, ওয়েস্টার্নসহ অন্তত ১৫টি ভারী শিল্পমালিক। এসব স্থানে কোম্পানিগুলো নির্মাণ করবে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কলকারখানা ও বহুতল ভবন। কুয়াকাটায় নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে ১৭ তলা ভবনের ওয়াচ টাওয়ার। মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় হবে আধুনিক পর্যটন এলাকা কুয়াকাটা। থাকবে এয়ারপোর্ট, স্টেডিয়ামসহ বহু স্থাপনা।
জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা থেকে কুয়াকাটার বিস্তৃত এলাকা ঘিরে পর্যটনভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান করতে যাচ্ছে সরকার, যার মনিটরিং করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। মাস্টারপ্ল্যানে থাকছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক পর্যটন স্থাপনা, শিল্পভিত্তিক বন্দরনগরী, পরিকল্পিত নগরায়ণ, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও কৃষি খাতে উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও দুর্যোগঝুঁকিসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাভিত্তিক কার্যক্রম। আগামী ২০ বছরে এ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করা হবে। ২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার এমবি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় রাঙ্গাবালীর সোনার চরে বিদেশি পর্যটকদের জন্য এক্সক্লুসিভ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার এবং কুয়াকাটা, বরগুনার তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলার সমন্বয়ে পর্যটন জোন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ২০১৬ সালে পায়রা-কুয়াকাটা ঘিরে মহাউন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে ২৭ সদস্যের সমন্বয় কমিটি করা হয় বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের পাশাপাশি পায়রা-কুয়াকাটা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামে একটি খসড়া আইন করা হয়েছে। আইনটি অনুমোদনের জন্য ক্যাবিনেটে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলে কর্তৃপক্ষ গঠনের গেজেট জারি করা হবে। আগামী ২০ বছরের মহাপরিকল্পনা নিয়ে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে। যে সাত উপজেলা নিয়ে নগর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার উপজেলাগুলো হলো, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, গলাচিপা, কলাপাড়া এবং বরগুনা সদর, তালতলী, আমতলী ও পাথরঘাটা। কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ জানান, পায়রা সেতু চালু হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে সারা দেশের পর্যটকরা পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টায় কুয়াকাটায় পৌঁছতে পারবেন। ফলে মানুষ ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে কক্সবাজার না গিয়ে স্বল্প সময়ে কুয়াকাটায় আসতে উৎসাহিত হবে। পর্যটন এলাকায় বিনিয়োগকারীরা তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাবেন। একদিকে কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে ব্যবসার প্রসার ঘটবে। সব মিলিয়ে দক্ষিণাঞ্চল হবে পর্যটনকেন্দ্রিক বড় জোন।
পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘পায়রা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে ফেরিবিহীন যোগাযোগ শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশের ফেরিবিহীন যোগাযোগ শুরু হবে। পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুরু হবে নতুন অধ্যায়। এর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে। তিনি জানান, কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দর ঘিরে ইতোমধ্যে দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা বিভিন্ন এলাকায় বিনিয়োগ করার জন্য জমি কিনেছেন। আবার কেউ কেউ কেনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। এখানে স্থাপিত হবে ইপিজেড। গোটা পটুয়াখালীতে বিভিন্ন ধরনের ভারী শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের চিন্তা করছেন ব্যবসায়ীরা। এসব কারণে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কুয়াকাটায় বহু কোম্পানি জমি কিনে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। উন্নয়নের ফলে অন্যান্য শিল্পমালিকরা উৎসাহিত হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন বলে আমার বিশ্বাস। সবকিছু মিলিয়ে ভবিষ্যতে দক্ষিণাঞ্চল হবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু।’ পটুয়াখালী তথা দক্ষিণাঞ্চল দেশের অর্থনীতি সচলে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই ব্যবসায়ী।
সূত্রঃ বিডি প্রতিদিন