বিশ্বের কোনো দেশ যুদ্ধে জড়ালে তার প্রভাব কম-বেশি অন্যান্য দেশেও পড়ে। তবে সবচেয়ে প্রভাব বেশি পড়ে সেই সব দেশে, যারা নানাভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ খাদ্য আমদানি, জ্বালানি আমদানি, নিট গার্মেন্ট রপ্তানি, এমনকি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশের ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ-রাশিয়ার যৌথভাবে সবচেয়ে বড় এবং আলোচিত প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করেছে, তখন বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে ভাবনায় পড়েছে সংশ্লিষ্টরা। শুধু রূপপুর প্রকল্প নয়, দেশের জ¦ালানি তেল, আমদানিকৃত এলএনজি বা লিকুইড গ্যাস আমদানি নিয়েও ভাবনার রেখা পড়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রূপপুর প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন হবে কিনা, সেটা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেছেন, ‘রূপপুর প্রকল্পে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। এদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান এনডিসি গণমাধ্যমকে বলেছেন, যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, সে ক্ষেত্রে রূপপুর প্রকল্পে প্রভাব পড়তে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই ক্ষতির কারণ হবে। তবে আমরা সরকারপ্রধানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানানোর চেষ্টা করব, রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নে যেন কোনো সংকট তৈরি না হয়।’
এদিকে মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে অবশ্যই রূপপুর প্রকল্পে প্রভাব পড়বে। প্রথম ইউনিট অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দ্বিতীয় ইউনেটে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা বেশি। তিনি বলেন, রাশিয়া রূপপুর প্রকল্পে শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা নয়, কারিগরি সহায়তাও দিচ্ছে। রাশিয়ান লোকবল কাজ করছে। ফলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে প্রকল্পে ধীরগতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
এদিকে রূপপুর প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘আশা করছি আগামী দু-একদিনের মধ্যে রূপপুর প্রকল্প নিয়ে মস্কো থেকে একটি বিবৃতি আসবে। সেই বিবৃতিতে হয়তো এসব আশঙ্কা নিয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকবে।’
এদিকে যুদ্ধের দামামায় জ্বালানির জোগান নিয়েও সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে ১০৫ ডলার পর্যন্ত উঠেছে। তেলের দামের ওপর ভিত্তি করে কয়লা এবং এলএনজির দর নির্ধারিত হওয়ায় ভবিষ্যতে এসব জ্বালানির দামেও বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। ফলে আমদানিনির্ভর জ¦ালানি খাত নিয়ে অনেক বেশি চিন্তায় সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ পেট্রোলিাম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেল বিক্রিতে প্রতিদিন ১৩ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে সংস্থাটি। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে তেলে ভর্তুকি বা লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে।
এদিকে বিপিসির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের জোগান নিশ্চিত করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে জাহাজ ভাড়া বা প্রিমিয়াম বেড়ে গেছে। এখন চুক্তিবদ্ধ থাকা কোনো কোনো জাহাজ কোম্পানি সময়মতো জ্বালানি তেল সরবরাহ নিয়ে টালবাহানা করছে।
জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারের ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, জ্বালানি তেল আমদানি করতে আগে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬০০ মিলিয়ন ডলার। এখন সেটা ৯০০ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঋণের পরিমাণ হয়তো ১২০০ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে।
দেশে গ্যাস ঘাটতির কারণে এলএনজি আমদানি করতে হয় সরকারকে। চলতি বছর প্রতিদিন ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট করে আমদানি করা এলএনজি পাইপলাইনে সরবরাহ করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় গত জুন-জুলাই থেকে কিছুটা কম আমদানি হচ্ছে। বিশেষ করে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। তবে গ্যাসের সংকটের কারণে সেটা বেশি দামে কিনে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে পেট্রোবাংলা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে এখন এলএনজির দামও চড়া।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী আল মামুন আমাদের সময়কে বলেন, এমনিতেই এক বছর ধরে বিশ^বাজারে এলএনজির দাম অনেক বেশি ওঠানামা করছে। এ অবস্থায় যুদ্ধের কারণে এলএনজি আমদানিতে প্রভাব পড়বে।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে আওয়ামী লীগ। ২০১০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্র্ণ ব্যবহার নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট হয়। একই বছর জাতীয় সংসদে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালে পাস হয় বাংলাদেশ অ্যাটোমিক এনার্জি রেগুলেটরি অ্যাক্ট। ২০১৩ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর্থিক বিবেচনায় এটি দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা।
এর মধ্যে রাশিয়া ৯০ শতাংশ দিচ্ছে ঋণ হিসেবে, যা প্রকল্পটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর পরবর্তী ২৮ বছরে পরিশোধ করা যাবে। প্রকল্প ব্যয়ের অবশিষ্ট ১০ শতাংশ অর্থ জোগান দেবে বাংলাদেশ। রূপপুর দুটি ইউনিট থেকে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। কেন্দ্রটির সব যন্ত্রপাতি তৈরি, সরবরাহ ও নির্মাণে কাজ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটম। প্রকল্পটিতে প্রায় ২০ হাজার লোকবল রয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ান নাগরিক রয়েছে প্রায় চার হাজার।
সূত্র: আমাদের সময়.কম