দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মুজিববর্ষে দেশের প্রতিটি ঘর আলোকিত করেছে সরকার, এটিই সব চেয়ে বড় সাফল্য। গতকাল সোমবার পটুয়াখালীর পায়রায় দেশের সবচেয়ে বড় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের পর শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওয়াদা করেছিলাম প্রতিটি মানুষের ঘরকে আলোকিত করব, প্রতিটি মানুষ আলোকিত হবে, সেই আলোর পথে আমরা যাত্রা শুরু করেছি। আজকের দিনটি সেই আলোর পথে যাত্রা শুরু যে সফল হয়েছে সেই দিন। তিনি আরও বলেন, আজকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা আলো জ¦ালতে পারলাম, এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। আমরা আলোকিত করেছি এদেশের প্রতিটি মানুষের ঘর। প্রধানমন্ত্রী পায়রায় একটি অনুষ্ঠানে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পরিবেশবান্ধব আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে এটিই প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সশরীরে সফর।
’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কোনো আন্তরিকতাই ছিল না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে ২০২২ সাল এই দীর্ঘ সময় সরকারে থাকতে পেরেছি সেজন্য কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। ভোট দিয়ে আমাদের তারা নির্বাচিত করেছেন। তিনি আরও বলেন, এই ১৩ বছর একটানা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অব্যাহত রয়েছে, এরমধ্যে ঝড়-ঝঞ্ঝা অনেক এসেছে, বাধা অনেক এসেছে কিন্তু সেগুলো আমরা অতিক্রম করেছি। এগুলো অতিক্রম করেও আমরা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে পেরেছি বলেই আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। তিনি বলেন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে জাতির পিতা একে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে রেখে গিয়েছিলেন। আজকে সেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর সামনে রেখে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জাতির জন্য উপহার হিসেবে উল্লেখ করেন। কেন্দ্রটি স্থাপনে সহযোগিতার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার রামনাবাদ নদীর পাশে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১০০০ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের ১৩তম দেশে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রের প্রথম ৬৬০ মেগাওয়াটের ইউনিট ২০২০ সালের মে মাসে বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়, ৪০০ কেভি পায়রা-গোপালগঞ্জ পাওয়ার ট্রান্সমিশন ব্যবহার করে এবং দ্বিতীয়টি গত বছরের ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরু করে।
কেন্দ্রটি বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল), চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এর মধ্যে একটি ৫০:৫০ যৌথ উদ্যোগ। ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ ইপিসি চুক্তি সই হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে, তারা তাদের জনসংখ্যার যথাক্রমে ৯৮ শতাংশ এবং ৭৪ শতাংশকে বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের আওতায় এনেছে।
প্রধানমন্ত্রী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামফলক উন্মোচন করেন এবং শান্তির প্রতীক ১৩২০টি পায়রা অবমুক্ত করেন এবং প্ল্যান্টের সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুম ঘুরে দেখেন। এর আগে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন হেলিপ্যাডে প্রধানমন্ত্রী পৌঁছালে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী কয়লা জেটিতে পৌঁছালে বিভিন্ন রঙে সজ্জিত ২০০ জেলে নৌকা থেকে চলন্ত পতাকা ও গান বাজিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির মহাপরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ এম খুরশেদুল আলম।
’৯৬ সালে সরকার গঠনের সময় দেশের অধিকাংশ অঞ্চল অন্ধকারে ডুবে থাকার এবং মাত্র ১৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, তাঁর সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সেই অবস্থা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে ৪ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট করে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী ৫ বছরে বিএনপি জামাত সরকার ১ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনতো বাড়াতেই পারেনি; বরং কমিয়ে ফেলে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ৩ হাজার ২শ’ মেগাওয়াট থেকে তাঁর সরকার আজকে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত করতে সক্ষম হয়েছে।
এই দক্ষিণাঞ্চলের দশমিনায় বীজ গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসহ লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল উৎপাদনে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ এই এলাকায় এখন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। অথচ সারাবছরে এখানে একটি মাত্র ফসল উৎপাদিত হতো। আর তাও প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হলে তাদের দুর্ভিক্ষে পড়তে হতো। আল্লাহর রহমতে আর সে দুর্ভিক্ষ হবে না এবং মানুষকে আর কষ্ট পেতে হবে না; বরং মানুষ উন্নত জীবন পাবে।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার ইতোমধ্যে রাঙ্গাবালী, নিঝুম দ্বীপ, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকায় নদীর নিচ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। আর যেখানে বিদ্যুতের গ্রিড লাইন নেই সেখানে সোলার প্যানেল করে দিচ্ছে। হাওরবাঁওড়, পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় এই সোলার প্যানেলের সাহায্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো ঘর আর অন্ধকারে থাকবে না, প্রতিটি মানুষের জীবন আলোকিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী উপকূলে সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলার এবং বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে উৎপাদনে নিজেদের সম্পৃক্ত করার জন্য তাঁর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি উদাহারণ দেন- একটি কাঁচামরিচ গাছও যদি পারেন আপনারা লাগাবেন এবং সবাই কিছু না কিছু উৎপাদন করবেন এবং কৃষকের পাশে দাঁড়াবেন।
সূত্র: আমাদের সময়.কম