এক সময় ছিল টেক্সটাইল মিলস। এখন সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যাটারির কাঁচামাল সিসা উৎপাদনের কারখানা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর ড্রিম হলিডে পার্কের ঠিক উল্টো পাশেই জেনিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডে উৎপাদন হচ্ছে এই সিসা। বিগত দেড় বছর ধরে চীনা নাগরিকরা এ কারখানা পরিচালনা করছেন। কিন্তু সরকারি কোনো দপ্তরের অনুমোদন তাদের নেই।
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কারখানাজুড়ে বসানো হয়েছে সিসার বার তৈরির মেশিন। সেসব মেশিনে উৎপাদিত সিসার বার, কাঁচামাল ও কয়লা কারখানার পুরো শেড জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক কোনো নিরাপত্তা সামগ্রী ছাড়াই কাজ করছেন বিষাক্ত এ কারখানায়। সংবাদকর্মীরা যেতেই তারা কাজ বন্ধ করে দেন।
কারখানায় সংবাদকর্মী প্রবেশের সংবাদে ছুটে আসেন এক চীনা নাগরিক। ইন ওয়েন উই নামে ওই চীনা নাগরিক নিজেকে কারখানার চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দেন। এসময় তার সঙ্গে থাকা দোভাষী আল-আমিন জানান, কারখানাটি এখনও চালু করা হয়নি। ট্রায়াল হিসেবে কিছু সিসা উৎপাদন করা হচ্ছে, যা বিভিন্ন ব্যাটারি কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সিসা পোড়ানোয় দূষিত ধোঁয়া আশপাশের পরিবেশের ক্ষতি করছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের ইটিপি আছে, এখনও চালু করা হয়নি। এরই মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে কারখানাটি উৎপাদনে যাবে।
তবে ভিন্ন কথা বলছেন স্থানীয় কবিরাজপুর গ্রামের বাসিন্দারা। তারা বলছেন, কারখানাটি পুরোদমে চালানো হয়। এরই মধ্যে কারখানায় সিসা পোড়ানোর বিষাক্ত ধোঁয়ায় কারখানার নারিকেল ও আম গাছের পাতা পুড়ে গেছে। এ কথাটির সত্যতা মিলল গাছের দিকে তাকাতেই।
কারখানার পেছনে বসবাস করা আফিয়া আক্তার বলেন, রাতে সিসা কারখানার ধোঁয়া ছাড়া হয়। এ কারণে এ বছর আম গাছে মুকুল আসেনি, অনেক গাছের পাতা পুড়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ায় আমাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। শুনেছি, এ ধোঁয়া নাকি বিষাক্ত। আমাদের শরীরে রোগ হবে। কিন্তু প্রশাসন যদি এসব বন্ধ না করে, আমরা কীভাবে বাঁচব?
বেগম নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ার গন্ধে আমরা রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারি না। রাতের দিকে ধোঁয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। এসব সিসার ধোঁয়া ও কারখানার বর্জ্যের কারণে আশেপাশের ফসলি জমির ফসল আগের মত হচ্ছে না। আমাদেরও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
আরাফাত মিয়া নামে এক স্কুলছাত্র বলেন, আগে কারখানাটি থেকে গরম পানি (বিষাক্ত তরল বর্জ্য) রাস্তায় ছেড়ে দিত। এতে এ রাস্তা দিয়ে আমরা চলাচল করতে পারতাম না। পরে কারখানার লোকজন পানি সরানোর জন্য পানির লাইন তৈরি করেছে।
শুধু এ কারখানা নয়, শিল্পনগরী নরসিংদীতে অন্তত এক ডজন ব্যাটারি তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে; যার অধিকাংশেরই পরিবেশ অধিপ্তরের ছাড়পত্র নেই। আর এসব কারখানার প্রায় সবগুলোর মালিক চীনা নাগরিকরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের বাদুয়ারচর এলাকার চিশতিয়া ব্যাটারি সার্ভিসিং, শীলমান্দি ইউনিয়নের খাটেহারা এলাকায় শিংসুন ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, কবিরাজপুর এলাকায় ফেইলং লেড কোম্পানি লিমিটেড, নুরালাপুর ইউনিয়নের ছোট রামচন্দ্রী এলাকার মেসার্স সানশাইন মেটাল রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মাধবদী পৌর এলাকার জিয়াং সু জিং ডিং স্টোরেজ কোম্পানি লিমিটেড ও বিএও নাং পাওয়ার টেকনোলজি লিমিটেড, পলাশ উপজেলার পারুলিয়া এলাকায় জিন উয়েন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি লিমিটেড ও সিং উয়ান স্টোরেজ লিমিটেড, রায়পুরা উপজেলার মরজাল এলাকার এশিয়া ব্যাটারি লিমিটেড ও শিবপুর উপজেলার পুরানদিয়া এলাকার এশিয়া কার বিডি লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাটারি ও কাঁচামাল তৈরি করা হয়।
কারখানাগুলো বিদ্যালয়, বাসস্ট্যান্ড ও বাজার লাগোয়া জনাকীর্ণ স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে। এসব কারখানার বেশিরভাগ মালিকই হচ্ছেন চীনের নাগরিক। তারা স্থানীয় ব্যক্তিদের জমি বা স্থাপনা ভাড়া নিয়ে এসব কারখানা গড়ে তুলেছেন। এগুলো নামে ব্যাটারি তৈরির কারখানা হলেও নিয়মিতই পোড়ানো হয় সিসা। আর সিসা পুড়িয়ে বানানো হয় ব্যাটারির প্লেট।
২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, বিষাক্ত গ্যাসে মাধবদী পৌরসভার কাশিপুর এলাকার মনিংসান স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস চলাকালে ঝাঁঝালো দুর্গন্ধে কয়েকজন শিক্ষার্থী বমি করতে থাকে। শিক্ষার্থীরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রশাসন ও স্থানীয়রা দেখতে পান, পাশেই একটি টেক্সটাইল কারখানার আড়ালে গড়ে ওঠা চায়না ব্যাটারি কারখানা থেকে নির্গত গ্যাস বাতাসে মিশে স্কুলের দিকে ধেয়ে আসার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
তখন স্থানীয়রা বুঝতে পারেন, চোখের আড়ালে তাদের সামনে চীনারা কত ভয়ংকর কারখানা গড়ে তুলেছেন। অদৃশ্য কারণে জিয়াং সু জিং ডিং স্টোরেজ কোম্পানি লিমিটেড নামে ব্যাটারি কারখানাটি প্রকৃতি ও মানুষের মরণযাত্রা চালিয়ে গেলেও এখনো এটি বন্ধ হয়নি। উল্টো পরিবেশের ক্ষতি করেই চলেছে এর কার্যক্রম।
সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ পরিবেশের ছাড়পত্র, ইটিপি, এটিপি, এসিড লাইসেন্স না থাকায় জিয়াং সু জিং ডিং স্টোরেজ কোম্পানি লিমিটেডকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন জেলা প্রশাসন পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই সঙ্গে মাধবদীর আরেকটি ব্যাটারি কারখানা পেং ইউ কোম্পানিকে ৭৪ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিনাত ফৌজিয়া।
কাশিপুর এলাকার জিয়াং সু জিং ডিং স্টোরেজ কোম্পানি লিমিটেড ব্যাটারি কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানার বিভিন্ন কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করে ব্যাটারি তৈরি করা হয়েছে। কারখানার বিভিন্ন সেকশনে শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। শ্রমিকরা খালি হাতেই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর সিসার মতো পদার্থ দিয়ে তৈরি করছেন ব্যাটারি। ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে শ্রমিকদের নেই কোনো সুরক্ষা সামগ্রী।
শ্রমিকরা জানান, চীনা নাগরিকদের তত্ত্বাবধানে কারখানায় প্রায় শতাধিক শ্রমিক রয়েছেন। কারখানায় প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার ব্যাটারি তৈরি করা হয়। যা দেশের বিভিন্ন স্থানের দোকানে সরবরাহ করা হয়।
ব্যাটারি কারখানায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা জানা আছে কিনা জানতে চাইলে কারখানার শ্রমিক আমির হোসেন বলেন, আমরা গরিব মানুষ, পেটের দায়ে কাজ করি। কারখানার কেউ তো কোনোদিন আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা জানাননি। তবে প্রায়ই কারখানার শ্রমিকদের কেউ কেউ মাথা ব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়া, শ্বাসকষ্টসহ নানা সমস্যায় ভোগেন।
জানতে চাইলে পাশের মনিংসান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান বলেন, ব্যাটারি কারখানাটির চারপাশেই আবাসিক এলাকা। এমন একটি জনবহুল এলাকায় ব্যাটারি কারখানাটি আমাদের জন্য বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারখানার সিসার বাতাসের কারণেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। তখন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্কুলে এসে পরিদর্শন করেছিলেন এবং আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু তারা এখনও বহাল তবিয়তে কারখানা চালিয়ে চাচ্ছেন। এ কারখানার বিষাক্ত সিসার ধোঁয়া ও বর্জ্যের কারণে এলাকার মানুষের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী রোগব্যাধি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মফিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাটারি কারখানাটির কারণে আমরা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। এর আগে কারখানার গ্যাসের গন্ধ স্কুলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমরা বিষয়গুলো চিঠির মাধ্যমে প্রশাসনকে জানিয়েছি। নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করেই কারখানায় উৎপাদন চালানো হচ্ছে। এখন তারা ইটিপি ব্যবহার না করে বর্জ্য সরাসরি ড্রেনের মধ্যে ফেলছে। যার ফলে পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে রয়েছে।
নরসিংদী জেলা সিভিল সার্জন ডা. নুরুল ইসলাম বলেন, ব্যাটারি তৈরির কারখানায় পোড়ানো সিসা প্রথমে মাটিকে আক্রান্ত করে। পরে তা বিভিন্নভাবে আমাদের মানবদেহে প্রবেশ করে, যা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে শিশুদের ওপর। শিশুরা সিসার বিষে আক্রান্ত হলে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়, পড়াশোনায় তাদের দক্ষতা থাকে না, তাদের বুদ্ধিমত্তাও লোপ পায়। এর ফলে প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের মানসিক বিকৃতি, রক্তশূন্যতা, কিডনি ফেইলর ও মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন হতে পারে। হতে পারে ত্বকের নানা রোগ। আর সিসার বর্জ্য কৃষি ক্ষেতে পড়ে, তা শাক-সবজির মাধ্যমে আমাদের শরীরের প্রবেশ করছে। তাই যত্রতত্র ব্যাটারি কারখানার অনুমোদন না দিয়ে সরকারের পরিবেশ দপ্তরের নিয়মনীতি মেনে বৃহৎ কোনো প্রতিষ্ঠানকে কারখানার অনুমতি দিলে পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র্য ও মানবদেহের ক্ষতির হুমকি কমে আসবে।
নরসিংদীর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহম্মদ হাফিজুর রহমান জানান, ব্যাটারি কারখানা পরিবেশের ক্ষতি করছে। কোনো কারখানাই এ পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধ্যতামূলক ছাড়পত্র নেয়নি। এরই মধ্যে অবৈধ ব্যাটারি কারখানার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাটারি কারখানাগুলো কোনোভাবেই চালাতে দেওয়া ঠিক হবে না।
জানতে চাইলে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান বলেন, পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যাটারি কারখানাগুলোর বিষয়ে জেলার মাসিক সমন্বয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সেখানে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যাটারি কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে।
সূত্রঃ বিডি প্রতিদিন