১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন মমতাজ বিবি। এরপর কেটে গেছে সাত দশকের বেশি সময়। অবশেষে দেশভাগের ৭৫ বছর পর প্রথমবারের মতো ভারতীয় ভাইদের দেখা পেলেন মমতাজ। বহু প্রতীক্ষার পর একে অপরকে কাছে পেয়ে আবেগে ভাসেন তারা।
তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- মমতাজ মুসলিম ধর্মের অনুসারী, আর তার ভাইয়েরা পালন করেন শিখ ধর্ম। মমতাজ আসলে শিখ পরিবারেরই সন্তান। দেশভাগের সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর পাকিস্তানি এক দম্পতি খুঁজে পায় মমতাজকে। তারাই তাকে দত্তক নিয়ে লালন-পালন করেন।
মমতাজের দুই ভাইয়ের নাম গুরমুখ সিং ও বলদেভ সিং। গত এপ্রিলে পাকিস্তানের কারতারপুর সাহিব গুরুদুয়ারায় বোনের সঙ্গে তাদের দেখা হয় বলে জানিয়েছে বিবিসি। গুরমুখ সিং বলেন, ‘জীবদ্দশায় আমাদের বোনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে আমরা খুব খুশি।’
১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন জাতির জন্ম হয়। ইতিহাসে কোনো যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের বাইরে লোকজন স্থানান্তরের এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ঘটনা। এ ঘটনায় ১ কোটি ২০ লাখের কাছাকাছি মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়েছিল এবং ১০ লাখের মতো মানুষ ধর্মীয় সহিংসতায় প্রাণ হারায়।
গুরুমুখ সিংয়ের বয়স এখন ৭০। তিনি বলেন, ‘এই সহিংসতা আমাদের বরবাদ করে দিয়েছে।’ তিনি জানান, সহিংসতার সময় তাদের মা নিহত হওয়ার পর তাদের বাবা পালা সিং পাকিস্তান থেকে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পাতিয়ালা জেলায় চলে আসেন।
গুরুমুখের ছোটভাই বলদেভ সিং বলেন, যখন তাদের বাবা স্ত্রীর মৃত্যুর কথা জানতে পারেন, তখন তিনি ধরে নিয়েছিলেন তার মেয়েকেও খুন করা হয়েছে। তারপর তিনি তার শ্যালিকাকে বিয়ে করেন (সেই সময়ের ঐহিত্য ছিল এটা)।
কিন্তু মমতাকে পাকিস্তানি মুসলিম এক দম্পতি খুঁজে পান। তারাই তাকে লালন-পালন করেছেন। দুই বছর আগে আমাদের ছেলেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে আমাদের সৎবোনকে খুঁজে পায়, যোগ করেন বলদেভ।
মমতাজ তার পরিবারকে খোঁজার কথা পাকিস্তানি ইউটিউবার নাসির ধিলনকে জানিয়েছিলেন। ওই ইউটিউব চ্যানেলটি দেশভাগের সময় আলাদা হয়ে যাওয়া আরও অনেক পরিবারের সদস্যদের একে অপরের সঙ্গে মিলন ঘটিয়েছে।
গুরমুখ সিং জানান, তারা মমতাজের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পাকিস্তানের শেখুপুরা জেলায় তাদের পৈতৃক গ্রামের এক দোকানদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, পরে তিনিই মমতাজের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দেন। তিনি জানান যে তাদের পরিবারে মমতাজের পরিচয় নিয়ে প্রথমে সন্দেহ ছিল।
তিনি বলেন, ‘সে (মমতাজ) অন্য কেউ হতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে তার সম্পর্কে আমরা তথ্যপ্রমাণ পাই, যা থেকে নিশ্চিত হই সে-ই আমাদের বোন। বিষয়টি জানার পর আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না।’
বলদেভ সিং বলেন, ‘আমরা যেকোনোভাবে তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে ভিসার একটা ইস্যু ছিল।’ পরে তারা আলোচনা করে ঠিক করেন একমাত্র পাকিস্তানের করতারপুর সাহিব গুরুদুয়ারই তাদের সাক্ষাতের কেন্দ্র হতে পারে, যেটি শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক দেবের শেষ বিশ্রামস্থল এবং পবিত্র মন্দির।
২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধনের পর থেকে হাজার হাজার মানুষ করতারপুর করিডোর দিয়ে ওই স্থান ভ্রমণ করে। ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে সেখানে।
গত ২৪ এপ্রিল গুরমুখ ও বলদেভ সিং সেখানে যান এবং তাদের বোনের সঙ্গে দেখা করেন। সে সময় মমতাজও তার পরিবার নিয়ে সেখানে এসেছিলেন।
বলদেভ বলেন, ‘আমরা একে অপরকে আলিঙ্গন করি। আমরা কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দ্রুত ভিসা পেতে চেষ্টা করছি। মমতাজ তার কাগজপত্র দাখিল করেছে যাতে করে সে আমাদের কাছে আসতে পারে।’
মমতাজ একটি মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। এ বিষয়ে গুরমুখ সিং বলেন তাদের দেখা হওয়ার পর পরিবার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন আমাদের দেখা হলো, তখন আমরা সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম।’
গুরুমুখ আরও বলেন, ‘আমাদের বোন মুসলিম তো কী হয়েছে? একই রক্ত তার শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। এটিই আমাদের কাছে অন্যকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র: আমাদের সময়.কম