পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনে ১০০ দিনের যুদ্ধে রাশিয়া সীমিত ভূখণ্ডে জয় পেলেও এ জন্য মস্কোকে বিশাল মূল্য দিতে হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, এ যুদ্ধ রাশিয়ার সামরিক শক্তির মিথকে ধ্বংস করেছে, পশ্চিমা জোট আবার শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে, যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ও বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ইউক্রেনের অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশটিতে পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন কয়েক দশকের, খুব সম্ভবত কয়েক শতাব্দীর সামরিক পাঠ ফের আলোচনায় এসেছে। গ্রিসের এথেন্সের হেলেনিক মিলিটারি একাডেমির ভূ-রাজনীতি এবং আধুনিক অস্ত্র ব্যবস্থার অধ্যাপক কনস্টান্টিনোস গ্রিভাস বলেছেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি যে, গোলাবর্ষণ হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে মৌলিক উপাদান। আমরা দেখেছি যে, উভয় পক্ষের আর্টিলারি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ষাটের দশকের একাধিক রকেট সিস্টেম এবং দূরপাল্লার ও উচ্চমাত্রার নির্ভুল এবং উচ্চ ধ্বংসাত্মক শক্তি কতটা কাজে লাগছে। রাশিয়া তার উচ্চতর গোলাবর্ষণে পিছিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, দেশটির কৌশলগত পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।যুদ্ধের এক মাসের মধ্যে তো ইউক্রেনকে বড় ধরনের ধাক্কাই দিতে পারেনি মস্কো।’ গ্রিভাস বলেন, ‘এটা পরিস্কার যে, রাশিয়া হেরে যাচ্ছে। হ্যাঁ, দেশটি যুদ্ধের বিশাল খরচে কিছু সামাল দিতে পারছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেশটি প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।’ হেলেনিক আর্মির প্রাক্তন সাঁজোয়া বিভাগের কমান্ডার এবং গ্রিসের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের প্রভাষক প্যানায়োটিস গার্জোনিকাস বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়া একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক লক্ষ্য স্থির করেছে, যা সামরিক উপায়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। রাশিয়ার দ্বিতীয় কৌশলটি ছিল পূর্ব ইউক্রেনের সব বাহিনীকে ঘিরে রাখা। মস্কো সেই প্রচেষ্টাও শেষ পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছে।
কখনও কখনও রাশিয়ার কৌশলগত দক্ষতার অভাবও স্পষ্ট ধরা পড়েছে। গত মাসে রাশিয়ার ৭৪তম মোটরাইজড রাইফেল ব্রিগেড পূর্ব ইউক্রেনের সিভারস্কি দোনেৎস্ক নদী অতিক্রম করার চেষ্টাকালে ইউক্রেনের বাহিনী তাদের ধ্বংস করেছে। এ সময় রুশ বাহিনী ধরা পড়ে এবং ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ ধরনের অযোগ্যতার মধ্যে রাশিয়ায় বিদ্রোহের খবর পাওয়া গেছে।
কনস্টান্টিনোস গ্রিভাস বলেন, ইউরোপের প্রতি রাশিয়ার প্রচলিত সামরিক হুমকিকে এতদিন বাড়িয়ে দেখা হয়েছে। তবে রাশিয়া যেসব জায়গায় সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি লাভ করেছে, সেখানে বিরামহীন গোলাবর্ষণ ছিল বড় শক্তি। রাশিয়ান বাহিনী সেভেরোদোনেৎস্কের যুদ্ধে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ওপর একই সঙ্গে মর্টার, আর্টিলারি এবং রকেট বর্ষণ করে সুবিধা অর্জন করেছে বলে মনে হচ্ছে। একই ধরনের কৌশলের ফলাফল মারিউপোলে দেখা যায়। সেখানে শহরের বেশিরভাগ অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
বিপরীতে ইউক্রেন তার সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনার পরিচয় দিয়েছে। এর মাধ্যমে কিয়েভ, চেরনিহিভ, সুমি ও খারকিভে রাশিয়াকে পরাজিত করেছে ইউক্রেন বাহিনী। ইউক্রেন বাহিনী এখন ধীরে ধীরে দক্ষিণে খেরসনে ফিরে যাওয়ার জন্য কৌশলগতভাবে পূর্বাঞ্চলীয় সেভেরোদোনেৎস্ককে পরিত্যাগ করছে। গবেষণা সংস্থা ওয়ার স্টাডি ইনস্টিটিউট বলেছে, কৌশলগতভাবে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ, খেরসন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড। এটি ইউক্রেনের একমাত্র এলাকা, যেখানে রাশিয়ার বাহিনী দিনিপ্রো নদীর পশ্চিম তীরের স্থলভাগ ধরে রেখেছে। যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে এবং রাশিয়া খেরসনে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলে সেখান থেকে ভবিষ্যতে আক্রমণ শুরু করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া অব্যাহত গোলাবর্ষণের মাধ্যমে ইউক্রেনকে পিষে ফেলছে। যুদ্ধবিশারদ গার্টজোনিকাস বলেছেন, সময় এখন রাশিয়ার অনুকূলে নয়। অন্যদিকে, ইউক্রেনের শক্তি বৃদ্ধিও ক্রমবর্ধমান। তা সত্ত্বেও রাশিয়া আরও কিছু অঞ্চল লাভ করতে পারে। ইউক্রেনও কিছু সাফল্য পেতে পারে। তবে এ যুদ্ধের মাশুল অনেক বেশি। তাই শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে একটি আপসরফা হতে পারে।
এরই মধ্যে এই যুদ্ধের মানবিক মূল্য স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর দাবি, তারা ৩০ হাজারের বেশি রুশ সেনাকে হত্যা করেছে। অন্যদিকে, জাতিসংঘ বলেছে যে, ইউক্রেনে ৯ হাজারের বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ৬৬ লাখের বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।