সম্প্রতি ন্যাটো সামরিক জোটের সঙ্গে জাপানের সম্পৃক্ততা লক্ষণীয়। ধারণা করা হচ্ছে, পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান ন্যাটোতে যোগদানের পরিকল্পনা করছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও ভুল করছে না। আগামী ২৯ ও ৩০ জুন স্পেনের মাদ্রিদে ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার।
কেন ন্যাটোয় যোগ দেবে জাপান
অতীতে জাপানের কোনো প্রধানমন্ত্রী ন্যাটোর দিকে পা বাড়ায়নি। তবে ফুমিও কিশিদা কেন ন্যাটোর দিকে ঝুঁকছেন? ইউক্রেনে রুশ সামরিক হামলা ন্যাটোর শক্তি অনেক বেশি প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। পশ্চিমা দেশগুলো নিরাপত্তার জন্য এখন ন্যাটোই ভরসা। বিশেষত ছোট দেশগুলো মনে করছে, ন্যাটো ছাড়া তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
তবে জাপান পশ্চিমের কোনো দেশ নয়। এশিয়ায় এর নিজস্ব শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। পশ্চিমের কোনো দেশ জাপানের সঙ্গে সংঘাতে আসবে–আপাতত সেই সম্ভাবনাও নেই। এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে অতীতে জাপানের যত্নশীল সম্পর্ক রক্ষা করেছে। গত দুই দশক তারা আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়েছে। সম্প্রতি জাপানের নেতা কিশিদা ইউক্রেন অভিযানের জেরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনেন।
জাপানের ন্যাটোমুখী হওয়ার প্রধান কারণ–চীন। অর্থনীতি ও সামরিক দিক থেকে চীনের উত্থান জাপানকে অস্বস্তিতে ফেলছে। এর আগে পূর্ব চীন সাগরের কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দুদেশ বিবাদ জড়িয়েছে। জাপান বলছে, দ্বীপগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্যদিকে চীনের দাবি, দ্বীপগুলোর মালিকানা বেইজিংয়ের। ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাই চীনকে মোকাবিলা করতে জাপান ন্যাটোয় যোগ দিতে পারে।
জাপানের সঙ্গে ন্যাটোর সম্পর্ক
ন্যাটো গঠনের শুরু থেকে অর্থাৎ নব্বইয়ের দশক থেকে ন্যাটোর সঙ্গে জাপানের সংলাপ ও সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। ইউরো-আটলান্টিক দেশগুলোর বাইরের দেশ হওয়া সত্ত্বেও ন্যাটো জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। কারণ, জাপান ‘বিশ্বজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার’ দেশ হিসেবে সুপরিচিত। ২০১৩ সালে ন্যাটো ও জাপানের মধ্যে যৌথ রাজনৈতিক সহযোগিতা জোরদারের চুক্তি হয়েছিল। এর পরের বছর ২০১৪ সাল থেকে অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা কর্মসূচির কাজ শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে সেই চুক্তি পুনঃনবায়ন করা হয়। সাইবার প্রতিরক্ষা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ত্রাণ, আধিপত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মানব নিরাপত্তা ও নারী, শান্তি ও নিরাপত্তাসহ অনেক ক্ষেত্রে তারা একসঙ্গে কাজ করে।
২০২০ সালে ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো ন্যাটোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে অংশ নেয় জাপান। বৈঠকে জাপানের সঙ্গে ছিল অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ। বৈঠকটির মূল বিষয় ছিল, বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা ও চীনের বিস্তার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাপানের সঙ্গে ন্যাটোর এটিই ছিল দৃশ্যমান রাজনৈতিক সংলাপ। ২০২১ সালে জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ন্যাটোর মিত্ররা এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে সহযোগিতাপূর্ণ দৃষ্টি রাখার বিষয়ে সম্মত হয়। ২০২২ সালের মার্চে ন্যাটোর মহাসচিব জেনারেল জেনস স্টটেনবার্গের সঙ্গে বৈঠক করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী।
ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে ফুমিও কিশিদা
জাপানের ইতিহাসে ন্যাটোর কোনো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ফুমিও কিশিদা। আগামী ২৬-২৮ জুন জার্মানিতে অনুষ্ঠেয় সাতটি শিল্পোন্নত দেশের জোট জি-৭-এর সম্মেলনে যোগ দেয়ার পর মাদ্রিদে ন্যাটোর বৈঠকে যোগ দেবেন তিনি।
শুধু জাপান নয়, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অংশীদার দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়াকেও ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও ইউক্রেনে সহায়তা প্রদান করে আসছে জাপান। জাপানি সংবাদমাধ্যম কিয়োদোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেন সংকটে আন্তর্জাতিক সংহতির একটি শক্তিশালী বার্তা হিসেবে সম্মেলনে কিশিদাকে স্বাগত জানানো হবে।
ন্যাটোয় যোগ দিতে জাপানের যে বাধা
ন্যাটোর ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক থাকতেও জাপান ন্যাটোভুক্ত হতে পারছে না তার সংবিধানিক নিষেধাজ্ঞায়। জাপানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে দেশটি যুদ্ধে জড়াতে পারবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালের ৩ মে এটি প্রণয়ন করা হয়। সংবিধানের এই বাধ্যবাধকতা দেশটিকে কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়া থেকে বিরত রেখেছে এবং যুদ্ধের জন্য সম্ভাব্য সামরিক বাহিনী নিযুক্ত করতে নিরুৎসাহিত করেছে।
সংবিধান প্রণয়নের ৭৭ বছর পরও ধারাটি অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ব-যুদ্ধপরবর্তী দখলদার যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায় ধারাটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এখন জাপান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা বদলেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জাপানও ন্যাটোর সদস্য হতে আগ্রহী।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত মে মাসে জাপান সফর করেছিলেন। জাপানে এসে তিনি চীনকে মোকাবিলার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপে (কোয়াড) যুক্তরাষ্ট্র-জাপান ছাড়াও সম্মেলনে যোগ দেয় ভারত-অস্ট্রেলিয়াও। দেশগুলো সামরিকভাবে চীনকে মোকাবিলার জন্য একই পথে হাঁটছে। আর বাড়তি নিরাপত্তা পেতে ন্যাটোকে কাছে পেতে চায় জাপান।
ন্যাটোভুক্ত হলে এশিয়ায় কোনো যুদ্ধ বাধলে ইউরোপীয়দের কাছে পাবে জাপান। আবার ন্যাটোও জাপানের আগমনে লাভবান হবে। এশিয়ায় জোটটির শক্তি বাড়বে এবং সামরিক ব্যয়ের কিছু ভার জাপানকে দিতে পারবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির সুযোগ বাড়বে। ভবিষ্যতে জাপানের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর আভাস পাওয়া গেছে।