বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বেতন পায় এমন ১২০জন ক্রিকেটার আছেন এখন। জাতীয় দলের সাথে চুক্তিবদ্ধ না হলেও এই ক্রিকেটাররা সরাসরি বাংলাদেশের ক্রিকেটের শীর্ষ স্তরের সাথে যুক্ত - অর্থাৎ জাতীয় দলে ডাক দেয়ার সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচকরা যখন চিন্তাভাবনা করেন কোন পজিশন ফাঁকা হলে কোন ক্রিকেটার নেবেন তখন এই ১২০ জন থেকেই কারও না কারও নাম সবার আগে উঠে আসে।
এই ১২০ জনে জায়গা করে নিতে একেকজন ক্রিকেটার দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিয়েছেন।
সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি বাংলাদেশের একজন ক্রিকেট বিশ্লেষক, একই সাথে তিনি এখনো বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের নথিভুক্ত ক্রিকেটার। প্রথম ডিভিশন লিগে খেলেন তিনি।
তিনি জাতীয় দল পর্যন্ত আসার যে রাস্তা সে অনুযায়ী এই পথকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন।
একটা হচ্ছে
-বয়সভিত্তিক অন্যটি
- ঢাকা লিগ ভিত্তিক।
মি. সামি বলেন, একটা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড দ্বারা পরিচালিত। এই ঘরানায় ক্রিকেটাররা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে- বিকেএসপি থেকে বয়সভিত্তিক দলে আসেন।
অনূর্ধ্ব ১৫, ১৭ ও ১৯ সারা দেশব্যাপী ঢাকা মেট্রো এবং সাতটা বিভাগ ও বিকেএসপিতে ট্রায়াল হয়।
ঢাকা মেট্রোর সাথে বাকি বিভাগগুলো একটি করে এবং বিকেএসপি একটি করে দল গঠন করে। এই দলগুলো নিয়ে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ হয়।
অনুর্ধ্ব ১৫ দল গঠন করে সেখানে যারা ভালো করে তাদের নিয়ে অনুর্ধ্ব ১৭ দল গঠন করা হয়, সেখান থেকে অনুর্ধ্ব ১৮ পর্যায়ের দল নিয়ে ওয়াইসিএল বা ইয়ুথ ক্রিকেট লিগ খেলা হয়। এই লিগ থেকে নির্বাচিত দলটি অনুর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট দলে সুযোগ পায়।
এই পদ্ধতির ভেতর দিয়ে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মেহেদী হাসান মিরাজদের মতো ক্রিকেটার উঠে এসেছেন।
বাংলাদেশের এই পর্যায়ের ক্রিকেটারদের তত্ত্বাবধায়ন করতেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম, যিনি একসময় গেম ডেভেলপমেন্টের ন্যাশনাল ম্যানেজার ছিলেন, তার অধীনে তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসানরা জাতীয় দলের জন্য তৈরি হয়েছেন।
মি. ফাহিম অনুর্ধ্ব ১৫, ১৭ দলগুলো নিয়ে বিদেশে সফরও করেছেন।
সেখানেই তিনি একেকজন ক্রিকেটারের মানসিক শক্তি, দক্ষতার জায়গা, ভবিষ্যৎ রূপরেখা সম্পর্কে ধারণা নিয়েছেন।
এই পাইপলাইনই বাংলাদেশের জাতীয় দলে প্রচলিত ও জনপ্রিয়।
বয়সভিত্তিক বাছাই প্রক্রিয়ার সমস্যা
এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে সনাতন বলছেন মি. সামি।
‘যারা এখানে কোচ থাকেন তারা অনেক সময়ই এক বল দুই বল দেখেই একটা মূল্যায়ন দিয়ে দেন। যেখানে অনেক ক্রিকেটারের অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটার সম্ভাবনা থাকে।’
এখানে কিছু সমস্যা থাকে বলে মনে করেন এই ক্রিকেট বিশ্লেষক।
‘আর একবার একজন ক্রিকেটার সেখানে বাদ পড়লে সে কিন্তু সেবার অনুর্ধ্ব ১৪ তে সুযোগ পেল না, এই ক্রিকেটার পরের বার বয়সের জন্য বাদ পড়ে যাবেন। আবার সেই ক্রিকেটার চর্চার অভাবে বা নির্দেশনার অভাবে অনুর্ধ্ব ১৬ পর্যন্তও যেতে পারে না।’
এটাকে একটা সামগ্রিক ব্যবস্থা বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
‘ভালো ক্রিকেটার পেতে ভালো কোচ প্রয়োজন,’ বলেন সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি।
নিজের ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা থেকেই বলেন, এখন অনেকেই নেটে হয়তো যথাযথ বেসিক মেনে খেলেন না, কিন্তু ম্যাচে তার প্রভাব থাকে।
এসব সীমাবদ্ধতা মেনেও তিনি বলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার সিলেকশনের যে প্রক্রিয়া তা এখনও পর্যন্ত মানসম্মত।
এই জায়গাটায় তিনি পেশাদারিত্ব নিয়ে আসার কথা বলেছেন আলাদা করে।
‘অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, এই পর্যায় পর্যন্ত আসার আগে কোনও বেতন আসে না। অথবা একটা নির্দিষ্ট মৌসুমে হচ্ছে, পুরো বছরজুড়েই হওয়া দরকার।’
ঢাকা লিগ ভিত্তিক ক্রিকেট
বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি বলেছেন, আরও একটা প্রক্রিয়া আছে সেটা হচ্ছে ঢাকার ক্রিকেট লিগ। এখানে কয়েকটা ডিভিশনে ক্রিকেটটা খেলা হয়। এই ডিভিশনের ক্রিকেটেও ক্রিকেটারদের নিজেদের প্রমাণ করার উপায় থাকে এবং এটা অনেক ক্রিকেটারের জন্য আয়ের উৎস।
বাংলাদেশে জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি লিগ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে অনেক ক্রিকেটার সাধারণ মানুষ বা সমর্থকদের চোখে নজর কাড়লেও তারা অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের দৃশ্যপটে থাকেন।
সেই খেয়াল রাখেন খালেদ মাহমুদ সুজন, মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের মতো কোচরা।
খালেদ মাহমুদ সুজন বাংলাদেশের জাতীয় পুরুষ দলের টিম ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন করেন। একই সাথে তিনি আবাহনী ও বিপিএল দলগুলোতেও কোচের ভূমিকায় থাকেন।
দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের তরুণ ক্রিকেটারদের তদারকি করেন তিনি।
যেমন আফগানিস্তানের বিপক্ষে ব্যাট হাতে ওপেন করা মুনিম শাহরিয়ার খালেদ মাহমুদ সুজনের সুনজরে আসার পর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ভালো পারফর্ম করে জাতীয় দলেও সুযোগ পেয়েছেন।
এমন করে শেখ মেহেদী হাসান বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলের এই নিয়মিত ক্রিকেটার ছিলেন মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের ছাত্র।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে খেলেন শেখ মেহেদী কোচ সালাউদ্দিনের অধীনে।
তাকেই বলা হয়, স্বাভাবিক সিস্টেমের বাইরের ক্রিকেটার।
আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্ন থাকে এই পর্যায়ে
তবে এই লেভেলের ক্রিকেটে পক্ষপাতিত্ব, সুপরিচিত ক্রিকেটারদের গুরুত্ব দেয়া, কোনও কোনও দলকে বাড়তি সুবিধা দেয়ার অভিযোগ থাকে।
এর আগে আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদ করে নিষিদ্ধও হয়েছেন বেশ কজন ক্রিকেটার।
সাকিব আল হাসান স্ট্যাম্পে লাথি মারেন গত বছর আম্পায়ারিং পছন্দ না হওয়ায়, তিনি অবশ্য শাস্তিও পেয়েছেন।
সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি এবারের আসর পর্যবেক্ষণ করে জানান, এবারের আসরটি তুলনামূলক স্বচ্ছ হয়েছে।
‘লিগগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকে ২১-২২ সেশনে মোটামুটি স্বচ্ছ ক্রিকেট হয়েছে তবে আম্পায়ারের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকেই। তবুও অন্যান্য বারের তুলনায় এবার ভালো ক্রিকেট হয়েছে।’
মি. সামি বলেন, এবারের লিগে হাবিবুর রহমান সোহান একটা দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।
পূ্র্বাচল স্পোর্টিং ক্লাবের এই ক্রিকেটার এবারই প্রথম ঢাকার লিগে খেলতে এসেই সাতশোর ওপর রান তোলেন, তিনি কোনও পর্যায়েই পেশাদার ক্রিকেট খেলেননি।
বিভিন্ন করপোরেট লিগে খেলে ঢাকার লিগে খেলতে এসেই মাতিয়েছেন। প্রথম বিভাগ লিগের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে দুটো শতক হাঁকিয়েছেন সোহান।
মি. সামি মনে করেন এটা সম্ভব হয়েছে ভালো আম্পায়ারিংয়ের কারণে।
তবে এখানে একটা বড় সমস্যা হচ্ছে এই ক্রিকেটাররা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে থাকেন না, তাই এই ক্রিকেটাররা ক্লাবগুলোর মুখাপেক্ষী থাকেন।
সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি বলেন, এরা কেউ পুরো বছর ক্রিকেটের সাথে থাকতে পারেন না। যেহেতু ক্রিকেটটা নিশ্চিত পেশা নয় তাদের কাছে।
ঢাকা লিগের ক্রিকেটাররা একটা সময় ক্রিকেট খেলেন বাকি সময় অন্য কোনও পেশায় কাটান বলে জানান মি. সামি।
এক মৌসুমে দুই থেকে চার লাখ টাকায় হয়তো ক্রিকেট খেলছে তারা- এটাকে পেশাদারিত্ব তৈরির ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করছেন এই বিশ্লেষক।
বয়স দিয়ে অনেক সময় ভুল মূল্যায়ন হয়
বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরও একটা সমস্যা হচ্ছে নির্বাচক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কোচরা মনে করেন জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হতে হবে তরুণ ক্রিকেটারের, এটাকে একটা ‘সমস্যা’ বলেই অভিহিত করেছেন মি. সামি।
তার মতে, এটা একেবারেই ভুল একটা ধারণা। এতে করে জাতীয় দলে খেলার যোগ্য অনেক ক্রিকেটারকেই ঠিক সেই নজরে দেখা হয় না।
ভারতে ২০২০-২১ সালে অভিষিক্ত তামিল নাডুর রাজ্য দলের ক্রিকেটার থাঙ্গারাসু নটরাজনের বয়স এখন ৩১।
অস্ট্রেলিয়ায় এমন উদাহরণই বেশি একজন ক্রিকেটার ২৬, ২৭ থেকে ৩০ বছর বয়সে অভিষিক্ত হচ্ছেন জাতীয় দলে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন একজন ক্রিকেটার ২২-২৩ বছর বয়সে শিক্ষানবিশ পর্যায়েই থাকেন।
সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামির পর্যবেক্ষণে, এই সময়টায় দক্ষতা দিয়ে অনেক কিছু করে ফেলে ঠিকই। কিন্তু মানসিকভাবে একজন ক্রিকেটার ততটা পরিপক্ক হয় না এই বয়সে।
সেকেন্ড ডিভিশন লিগে এবার সর্বোচ্চ রান তুলেছেন সালাউদ্দিন পাপ্পু, তিনি বারোশোর মতো রান তুলেছেন, তার বয়স ৪৫।
মি. সামি মনে করেন, তিনি হয়তো জাতীয় দলের জন্য বিবেচিত হবেন না যৌক্তিক কারণেই কিন্তু ডিভিশনাল লেভেলের ক্রিকেটে যারা পারফর্ম করেন তাদের অনেকেরই বয়স ২৮-২৯। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের যেসব নির্বাচকরা এই পর্যায়ের ক্রিকেট অনুসরণ করেন তারা খোঁজ রাখেন ২৩-২৪ বছর বয়সী ক্রিকেটারদের দিকে।
একাডেমি ক্রিকেট
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড একাডেমি ক্রিকেটের দিকেও নজর রাখে।
এ দল ও এইচপি দলের জন্য বিদেশি কোচও নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।
ঢাকায় একটি টুর্নামেন্ট আয়োজিত হচ্ছে যার নাম একাডেমি কাপ। এই টুর্নামেন্ট থেকে সেরা ক্রিকেটারদের বাছাই করা হয়।
ঢাকায় বর্তমানে ৮৯টি ক্রিকেট একাডেমি রয়েছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গেম ডেভেলপমেন্টের একজন কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, যত একাডেমি থাকবে আমাদের জন্য সেটা তত ভালো। আমরা সেখান থেকে (খেলোয়াড়) তুলে আনি। অনুর্ধ্ব-১৪ বলেন অনুর্ধ্ব-১৮ হোক একাডেমি থেকেই তারা এই পর্যায়ে আসেন।
এক্ষেত্রে ঢাকার চেয়ে রাজশাহীর একাডেমিগুলো থেকে বেশি ক্রিকেটার আসেন বলেন তিনি।
বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলা সাইফ হাসান, নাজমুল হোসেন শান্তর মতো ক্রিকেটাররা এই পর্যায়ের ক্রিকেট খেলে উঠে এসেছেন।
তবে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের একটা বড় অংশ এসেছে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই।
বিকেএসপি থেকে আসা সেরা ক্রিকেটার:
নাঈমুর রহমান দুর্জয়
আল শাহরিয়ার রোকন
সাজিত হাসান
মোহাম্মদ রাহুল
সাজ্জাদ হোসেন শিপন
আব্দুর রাজ্জাক
আনোয়ার হোসেন
সাব্বির রহমান
মুশফিকুর রহিম
সাকিব আল হাসান
নাঈম ইসলাম
নাসির হোসেন
কাজী শাহাদাৎ হোসেন
সগির হোসেন পাভেল
আনামুল হক বিজয়
মমিনুল হক
শামসুর রহমান
সোহরাওয়ার্দী শুভ
সৌম্য সরকার
লিটন দাস
তানভীর আহমেদ
মোহাম্মদ মিঠুন
আরিফুল হক
জাকির হাসান
সূত্র: বিবিসি