নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি, বিজ্ঞাপন আয়ের উৎসে কর কমানো এবং সংবাদপত্রের করপোরেট কর হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ থেকে ১২ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। সংবাদপত্র শিল্পের টিকে থাকার স্বার্থে সরকারের কাছে এ দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
আগামী বাজেটকে সামনে রেখে গতকাল সোমবার ‘আসন্ন বাজেট এবং বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পের সমস্যা ও সংকট’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব দাবি জানানো হয়। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এ গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়। নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. নিজামুল হক। আরও উপস্থিত ছিলেন নোয়াবের নির্বাহী সদস্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, দৈনিক সংবাদের সম্পাদক আলতামাস কবির, এফবিসিসিআই সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, বিসিআই’র সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (একাংশ) সভাপতি এম আবদুল্লাহ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (একাংশ) সভাপতি ওমর ফারুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সম্পাদক ও নোয়াবের নির্বাহী কমিটির সদস্য দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। অনুষ্ঠানে বলা হয় সরকারি বিজ্ঞাপন বাবদ বিল ১০০ কোটি টাকা বাকি। এই অর্থ পরিশোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেন উপস্থিত সাংবাদিক নেতারা।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। এতে বলা হয়, শ্রম আইন ২০০৬ ২ (৬০) ধারা অনুসারে সংবাদপত্র একটি শিল্প। আর ২রা এপ্রিল ২০১৪ সংবাদপত্রকে সেবা শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে ছাপা সংবাদপত্র রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। সেবা শিল্প হওয়া সত্ত্বেও সরকারের কাছ থেকে বিশেষ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। করোনাকালে কোনো সুবিধা বা প্রণোদনা পায়নি। সংবাদপত্রের উৎপাদন খরচ বিক্রি মূল্যের কয়েক গুণ। বিজ্ঞাপন আয় দিয়ে উৎপাদন ব্যয়ের ঘাটতি পূরণ হতো আগে কোনোভাবে। এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এখন নিউজপ্রিন্টের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। দেড় বছর আগে যেখানে প্রতি টনের দাম ছিল ৫৭০ ডলার, এখন সেখানে দাম ১০৫০ ডলার। এখন আবার ডলারের দাম বাড়ছে। পাঠক ও বিজ্ঞাপন বাড়ছে অনলাইনে। আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলোকে ছাপা কাগজের পাশাপাশি অনলাইন বা ডিজিটাল ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে।
তৈরি পোশাক শিল্প একটি মুনাফা অর্জনকারী শিল্প হওয়া সত্ত্বেও এর করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১২ শতাংশ। অথচ সংবাদপত্র সেবা শিল্প হওয়া সত্ত্বেও একে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, অনিবন্ধিত কোম্পানি ও নন-রেসিডেন্সিয়াল ক্যাটাগরিতে ধরা হয়েছে এবং করপোরেট ট্যাক্স ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই শিল্পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আর্থিক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। সংবাদপত্রের মতো রুগ্ণ শিল্পের করপোরেট ট্যাক্স ১০% এর চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয়।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ এর শিডিউল-১ এ ভ্যাটমুক্ত পণ্যের তালিকায় পার্ট-২ তে বিশেষ সুবিধা প্রদানের নিমিত্তে ভ্যাট হতে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেবার তালিকায় সংবাদপত্র অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কাস্টমস প্রসিডিউর কোড (সিপিসি) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকায় নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫% ভ্যাট দিতে হচ্ছে। ভ্যাট অব্যাহতি অথবা সর্বোচ্চ ৫% ভ্যাট করা উচিত।
সংবাদপত্রের আমদানি শুল্ক ও ল্যান্ডেড কস্ট: সংবাদপত্রের প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্টের ওপর বর্তমানে ৫% আমদানি শুল্ক দিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে মূল্য সংযোজন কর (১৫%) ও এআইটি (৫%) মিলে ল্যান্ডেড কস্ট প্রায় ১২৭%। উপরন্তু পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এটা আসলে ১৩০% এর উপরে চলে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমদানি শুল্ক ০% করা জরুরি। নোয়াব যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করার চেষ্টা করছে।
আলোচনার শুরুতে নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের সমস্যা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেটের পূর্বে আলোচনা করার দরকার, তাই এই আয়োজন। শিল্প হিসেবে সংবাদপত্রের স্বীকৃতি রয়েছে। অন্যান্য শিল্পের সমস্যার চেয়ে সংবাদপত্রের সমস্যা ব্যতিক্রম। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল শিল্পে ব্যবহূত মৌলিক কাঁচামালে শূন্য শুল্ক আরোপ করা হলে আমদানি নির্ভরশীলতা কমবে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের দেশীয় শিল্প বাড়বে। আমদানির ওপরে চাপ কমবে পাশাপাশি রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও হবে। এ বিষয়টি এনবিআরকে বোঝাতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে বাজেটে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও অন্যান্য শিল্পের মতো সুযোগ আমরা পাচ্ছি না। তিনি বলেন, প্রায় ২০ বছর যাবৎ আমরা যখনই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করি তারা অনুধাবন করেন, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। একটা কাগজ তৈরিতে খরচ হয় ২৩ টাকা, আমরা ১০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করি, বিশেষ করে বড় পত্রিকাগুলো। ৬ টাকা আমরা রেখে ৪ টাকা হকারকে ছেড়ে দেই। বিজ্ঞাপন হচ্ছে আয়ের মূল উৎস। করোনার কারণে এবং করোনা পরবর্তীতে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা দুনিয়ায় মূল্যস্ফীতি। তারমধ্যে এমনিতেই বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এরপর বিজ্ঞাপনের উপরেও আবার ৯ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। এরমধ্যে ৪ শতাংশ টিডিএস, এআইটি ৫ শতাংশ। করপোরেট ট্যাক্স দিতে হচ্ছে ৩০ শতাংশ। এমনিতেই রুগ্ণ শিল্প, তারপরও এসব বাধায় আমাদের এগিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে।
বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, বাজেটের আগে বিভিন্ন দাবি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু ফলাফল তেমন একটা পাওয়া যায় না। তবে এসব আলোচনা উপকারী। এর মাধ্যমে একটা সুনির্দিষ্ট পথে আমরা আগাতে পারবো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও জানতে পারবে আসলে সংবাদপত্র কী কী অসুবিধায় আছে। সৎ উদ্দেশ্যে কাজ করলে এগুলোও সমাধান করবেন তারা, সেই বিশ্বাস আমার আছে। সরকারকে এসব বিষয় বিশেষ করে ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে সরাসরি জানানো দরকার। সরকার জানে। তারপরও একতাবদ্ধভাবে একধরনের ফোর্স তৈরি করে জানালে আশা করি সফলতা আসবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নোয়াব যে তথ্যগুলো তুলে ধরেছেন সেগুলো যৌক্তিক। সংবাদপত্র সেবা শিল্প হলে ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর জন্য দেন-দরবার করার কোনো দরকার হয় না। আমি মনে করি নোয়াবের দাবি অন্তত যৌক্তিক।
ডেইলি স্টার সম্পাদক ও নোয়াবের নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহফুজ আনাম বলেন, সংবাদপত্রের এই ব্যবসা সামাজিক সেবাধর্মী। করোনার সময় আপনারা দেখছেন, এ খাত কীভাবে সমাজের জন্য অবদান রেখেছে। সরকার বিপুল পরিমাণ আর্থিক প্রণোদনা দিলেও সংবাদপত্র শিল্প একটি টাকাও পায়নি। ট্যাক্সের ক্ষেত্রে আমরা যেন ছাড় পাই, নইলে বাঁচবো না। রুগ্ণ হয়েও সর্বোচ্চ করপোরেট কর দিতে হচ্ছে। সংবাদপত্র থেকে সামান্য রাজস্ব পায় সরকার। ফলে সামাজিক সেবা বিবেচনায় এ খাতকে কর ছাড় দেয়ার দাবি করেন তিনি।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আজকে নোয়াব যে হিসাব দিয়েছে তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। একটা পত্রিকা বের হতে ২৩ টাকা খরচ হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে ৬ টাকা। একটা পত্রিকার সার্কুলেশন যত বেশি হচ্ছে তার তত বেশি ক্ষতি হচ্ছে। ব্যয়টা বিজ্ঞাপন দিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। এরপরেও সরকারের নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ দেখছি। আমরা শুনি বা জানি বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে কিছু পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার ক্ষেত্রে। আর সরকারি বিজ্ঞাপন দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু উদ্ভট হিসাব দেয়া হয় পত্রিকা সার্কলেশনের। পত্রিকার সার্কুলেশনের যে হিসাব দেয়া হয় এটা একটা অবিশ্বাস্য। এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমরা যে পত্রিকার নাম জানি না সে পত্রিকা আড়াই লাখ কপি চলে। এবং চারটা/পাঁচটা পত্রিকার অবিকল একই রকম সার্কুলেশন। অর্থাৎ মিথ্যাটাও ঠিকমতো লিখতে পারে না। এই রকমভাবে যখন সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টিত হয়। আর এই টাকাও যখন বাকি রাখা হয়। তখন সংবাদপত্রের শিল্পের সুষ্ঠুভাবে টিকে থাকার সকল সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যায়।
এফবিসিসিআই জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, বাজেট ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনের পর পরই এফবিসিসিআই নোয়াবের ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর বিষয়ে আলোচনা করবে। পাশাপাশি এফবিসিসিআই শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
মনজুরুল আহসান বুলবুল সংবাদপত্রের সংকটে সবাইকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, এই শিল্পের সংকট যদি আমরা বুঝি তাহলে সমস্যার সমাধান সম্ভব।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, সংবাদপত্র যেহেতু সেবাপণ্য তাই এখানে সরকারকে সহায়তা করতে হবে। নোয়াবের দাবি যৌক্তিক। সর্বজনীন পেনশনের কথা বলা হচ্ছে। সাংবাদিক থেকেই শুরু করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এম আবদুল্লাহ বলেন, বর্তমান সময়ে সংবাদপত্র শিল্প খাদের কিনারে। প্রত্যেক বছর সংবাদপত্রের সংকট নিয়ে নোয়াব দাবি জানিয়ে আসছে কিন্তু কারও কাছে এটা কোনো গুরুত্ব পায়নি। অনেকটা অরণ্য রোদন।
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক সংবাদপত্রের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। নোয়াবের সংকটের সঙ্গে একমত পোষণ করেন তিনি।
আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সংবাদপত্র সেবা শিল্প, এই শিল্পকে বাঁচাতে হবে। কোনোভাবেই যেন বন্ধ না হয়ে যায়।
সূত্র: মানবজমিন