চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ মজুদের লাইসেন্স বা অনুমতি না থাকার পরও কিভাবে তা রাখা হয়েছিল এবং প্রাণহানি বা ভয়াবহ পরিস্থিতি যা হয়েছে, সেখানে দায় ও ব্যর্থতা কার? এসব নানা প্রশ্নে এখন আলোচনা চলছে।
সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পেছনে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে পরিবেশ অধিদফতর।
প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে এ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ডিপোতে বেশ কয়েকটি কন্টেইনারে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মজুদ থাকার বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের পদার্থ মজুদের ব্যাপারে কোনো অনুমতি ছিল কিনা, এ প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে।
ডিপোতে আগুন লেগে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে, ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড এবং কোনো রাসায়নিক পদার্থ মজুদের অনুমতি ছিল না বলে পরিবেশ অধিদফতর জানায়।
কিন্তু ডিপোটিতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ২৪টি কন্টেইনার রফতানির জন্য রাখা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এ তথ্য পাওয়া গেছে বলে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী জানান।
পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মফিদুল আলম বলেন, বিএম কন্টেইনার ডিপো রাসায়নিক পদার্থ রাখার ব্যাপারে কখনো কোনো লাইসেন্স পায়নি।
তিনি জানান, অরেঞ্জ-এ, অরেঞ্জ-বি ও রেড-কন্টেইনার - এ তিন ক্যাটাগরিতে ডিপোগুলোকে তারা লাইসেন্স দিয়ে থাকেন।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বা কোনো রাসায়নিক পদার্থ মজুদের জন্য রেড লাইসেন্স দেয়া হয়। আর এ রেড লাইসেন্স পেতে হলে অর্থাৎ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বা অন্য কোনো রাসায়নিক পদার্থ মজুদের ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস এবং বিস্ফোরক পরিদফতরের অনুমতিপত্র নিতে হয়।
ওই অনুমতিপত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ অধিদফতর রেড লাইসেন্স বা অনুমতি দিয়ে থাকে।
পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা মফিদুল আলম বলেন, বিএম কন্টেইনার ডিপোর ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক পরিদফতরের কোনো অনুমতিপত্র ছিল না। ফলে ওই ডিপো অরেঞ্জ-বি লাইসেন্স পেয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পরিবেশ অধিদফতরের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, তাদের (বিএম কন্টেইনার ডিপো) হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও কোনো রাসায়নিক দ্রব্য মজুদের অনুমতি না থাকলেও ঘটনার পর আমরা সরেজমিনে দেখেছি, ওই ডিপোতে তা (হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড) ছিল।
মফিদুল আলম উল্লেখ করেন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থাকার কারণে ডিপোতে অন্য কোনো কিছু থেকে আগুন লেগে এ ধরনের পরিস্থিতি হয়। প্রাথমিক তদন্তে এমনটাই মনে হচ্ছে।
আলম এ পরিস্থিতির দায় চাপিয়েছেন ডিপোর মালিক কর্তৃপক্ষের ওপর।
ডিপোতে কী রাখা হচ্ছে, তা পরিদর্শন করার দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্নে করলে এ কর্মকর্তা বলেন, লাইসেন্স প্রতি বছর যখন নবায়ন করা হয়, তখন তারা তা পরিদর্শন করে থাকেন।
এছাড়া ডিপো কর্তৃপক্ষ থেকেও তাদের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মজুদের বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।
অন্যদিকে রফতানির জন্য ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মজুদের ঘোষণা সম্পর্কিত চট্টগ্রাম কাস্টমসের একটি ডকুমেন্ট প্রকাশ হয়, সে ব্যাপারে আলম বলেন, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।
বিস্ফোরক অধিদফতরও কোনো দায় নিতে রাজি নয়।
এ অধিদফতরের উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক বলেন, আইন অনুযায়ী হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মজুদের অনুমতি বা ছাড়পত্র দেয়া তাদের দায়িত্ব নয়। তবে তারা অন্য সব রাসায়নিক দ্রব্যের অনুমতি দিতে পারেন।
সীতাকুণ্ডে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুর রহমান বলেন, ব্যর্থতার দায় কার? এসব প্রশ্নের জবাব মিলবে তদন্তের পর।
প্রতিমন্ত্রী জানান, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এখানে প্রায় সাড়ে চার হাজার কন্টেইনার ছিল। এর মধ্যে ২৪টি কন্টেইনার রাসায়নিক পদার্থের। বাকিগুলো গার্মেন্টস প্রডাক্ট রফতানির জন্য রাখা হয়েছিল।
রাসায়নিক পদার্থ বলতে কি বোঝানো হচ্ছে, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান বলেন, ২৪টি কন্টেইনারে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছিল, সেটাই ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে।
ডিপোতে যখন আগুন লেগেছিল, তখন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মজুদের বিষয়ে ডিপো কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য দেয়নি। সেজন্য প্রথাগতভাবে পানি দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে বিস্ফোরণে অনেক মানুষের প্রাণহানিসহ ভয়াবহ পরিস্থিতি হয় বলে চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ ডিপোটি স্মার্ট গ্রুপ নামের যে ব্যবসায়ী গ্রুপের, সেই গ্রুপের মালিক মজিবর রহমান এখনো তার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সইড মজুদের বিষয়টি অস্বীকার করছেন।
যেসব অভিযোগ ও প্রশ্ন উঠেছে, সে বিষয়গুলোতেও তিনি পরিষ্কার করে কিছু বলেননি।
তিনি বলেন, আমার বক্তব্য হলো, আমি তো দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবসা করছি, আমার মার্কেটে গুডউইলটা দেখেন। অ্যাক্সিডেন্ট যখন হয়ে গেছে, আমি কী করতে পারি।
তিনি ঘটনায় নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে এককালীন ১০ লাখ টাকা ও প্রতি পরিবার থেকে একজনকে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি আহতদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতিও দেন।
তবে পরিবেশ অধিদফতর বলছে, ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছিল। কিন্তু এটিসহ কোনো রাসায়নিক পদার্থ মজুদের অনুমতি নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মজিবর রহমান বলেন, স্থানীয় যে আইন আছে, তা দেখেন। কেন ঘটছে, এটা দেখেন। আমরা তো সেফটি নিশ্চিত করেছি। আমাদের এটা সেফটি কমপ্লায়েন্ট।
ডিপোটির মালিক পক্ষ পরিস্থিতির জন্য ব্যর্থতার দায় নিতে রাজি নয়।
এ গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক অবসরপ্রাপ্ত মেজন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, তাদের ডিপোতে হাইড্রেজেন পার-অক্সাইড মজুদ ছিল কিনা - তা তদন্ত শেষ হওয়ার আগে তারা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
একইসাথে তিনি উল্লেখ করেন, অনুমতি না থাকলেও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ওই ডিপোতে কিভাবে আনা হলো এবং এটা কোনো নাশকতা কিনা, এ প্রশ্ন তাদের রয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদেরও প্রশ্ন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থাকলে সেখান থেকে অন্য জায়গায় যে রফতানি করে, ওই রফতানির সময়ওতো ধরা যায় যে তুমি এটা কিভাবে আনছো? এই কথাটার উত্তরের জন্য বলছি, এর তদন্ত করলেই তা বের হবে।
এদিকে সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান বা বিভাগের বিষয়গুলো দেখভাল করার কথা, তারাও ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।
সূত্র : বিবিসি