ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মুখপাত্ররা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে দেশটিকে বিশ্বমঞ্চে চাপে ফেলেছে। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক হুমকিতে পড়েছে। হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার পরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায় অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)। এমনকি জাতিসংঘকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে নিন্দা জানিয়েছে কাতার, কুয়েত, ইরান, পাকিস্তান, সৌদি আরব, ওমান ও গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক ও দেশগুলোতে কর্মরত কয়েকজন ভারতীয়কে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ভারতে মুসলিমবিরোধী কর্মকাণ্ডের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটিতে মুসলমানদের ওপর হামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে করোনা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার তাবলিগ জামাতকে দোষারোপ করেছিল। সে সময় দেশটিতে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। গরু রক্ষার নামেও বেশ কয়েকজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনায় উপসাগরীয় অঞ্চলে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক তথা মোদির ভাবমূর্তি তীব্র সংকটে পড়েছে। বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ তাদের রাজধানীতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের ডেকে নিয়ে ভর্ৎসনা জানিয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বকে শান্ত করতে বিতর্কিত বিজেপির দুই মুখপাত্রকে তাদের পদ থেকে সরানো হয়েছে। বিজেপির দাবি, আক্রমণাত্মক কোনো বক্তব্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না। তবে এ ঘটনা মোদি সরকারের ইসলামবিদ্বেষী চেহারা তুলে ধরে ধরেছে এবং দেশটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মহানবীকে (স.) নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের পর ভারতের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর তারা কত নির্ভরশীল। উপসাগরীয় দেশগুলো (ওমান, ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও কুয়েত) ভারতের স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোদি সরকারের সঙ্গে দেশগুলোর নিবিড় সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। সেই দেশগুলো এখন দিল্লির ওপর নাখোশ হয়ে আছে। ভারতের রেমিট্যান্স, বাণিজ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তায় এ অঞ্চলের অবদান কম নয়। অঞ্চলটিতে প্রায় ৮০ লাখ ভারতীয় প্রবাসীকর্মী কাজ করেন। এ ছাড়া জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে কাজ করে।
উপসাগরীয় অঞ্চলগুলোর সঙ্গে দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্ক ধর্মভিত্তিক ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ধর্মকেন্দ্রিক বিতর্ক সেই সম্পর্কে ভাটা ফেলেছে। ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ওমানে এক যুগ (২০০০ থেকে ২০১১) দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রদূত তালমিজ আহমেদ বলেছেন, ভারতে অতীতেও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু উপসাগরীয় দেশগুলো সেসব ঘটনাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু এখন মহানবী (সা.) ও তার স্ত্রী বিষয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে ভারত সীমা অতিক্রম করেছে। এর আগে যখন বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল তখনো ভারতকে বহুত্ববাদে বিশ্বাসী, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভারতের সেই ইমেজ পালটে গেছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর এত ক্ষোভের মধ্যে নয়াদিল্লি আশা করছে, এ ঘটনা উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব বেশি প্রভাবিত করবে না। কারণ, ভারতের সঙ্গে দেশগুলোর সম্পর্ক কৌশলগত, বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগনির্ভর। নিজ স্বার্থেই তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে। ভারতের কাছে তেল বিক্রি ও দেশগুলোতে ভারতের বিশাল কর্মী বাহিনী এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি। সেখানে কখনো ধর্মীয় বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
এ ছাড়া জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস দমনে দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তাগত সহযোগিতা সম্পর্ক রয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারত যৌথ সামরিক মহড়াও চালিয়ে থাকে। গত মার্চে ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট নামে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এটি পারস্য দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য শুরুর যাত্রাস্থল হিসেবে দেখা হয়েছিল। তবে মুসলিমবাসী যখন হ্যাশট্যাগ দিয়ে #বয়কিইন্ডিয়ানগুডস অর্থাৎ ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন বলে প্রতিবাদ করছে তখন উপসাগরীয় ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে পড়েছে।
মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার সুফল নিয়ে আসছে ভারত। জাতিগত বৈচিত্র্য ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য বিশ্বপরিমণ্ডলে ভারতের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙা, মুসলিম নিপীড়নের জন্য খুব সংবেদনশীল দেশ ভারত। বিজেপির বিরুদ্ধে বরাবরই জাতিগত নৈরাজ্যবাদের অভিযোগ ওঠে। তালমিজ আহমেদ মনে করেন, সাম্প্রতিক ঘটনায় ভারতীয় কর্মসংস্থানের ওপর বড় প্রভাব পড়বে। শুধু তাই নয়, এই ঘটনা ভারতের জন্য একটি বড় হুঁশিয়ারি। ভারতকে বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই ঘটনা ভারতের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।