দেশে একদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে। মহামারি করোনার অভিঘাতে এবং মূল্যস্ফীতির চাপে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের আয় কমলেও কিছু মানুষের আয় বেড়েছে। ফলে এসময় আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে আয় বৈষম্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশে এখন কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭ টি। ২০২১ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার বেশি আমানতের হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৪ হাজার ২৭২টি। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৯ হাজার ৩২৫টি।
অপরদিকে এক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, করোনায় নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ৭৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৩। যাদের হিসাবে জমা ছিল ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মার্চ আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৮৫ লাখ ৫২ হাজার। তাদের হিসাবে জমা ছিল ১৩ লাখ ৮৪ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। বিনিয়োগকারীরাও নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ফলে একদিকে যেমন মানুষের কর্মসংস্থান কমে গেছে অন্যদিকে ব্যাংকে বিনিয়োগকারীদের অলস অর্থ জমা হচ্ছে। এতে দেশের আয় বৈষম্য বাড়ছে।
এছাড়া, দুর্নীতির মাধ্যমে কালোটাকা অর্জন, হন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা ভিন্ন খাতে স্থানান্তর, করনীতিতে অসামঞ্জস্য, ধনীদের কাছ থেকে কম হারে কর আদায়ও দেশের আয় বৈষম্যের অন্যতম কারণ। এসব কারণে এক শ্রেণির মানুষের বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আয় বাড়ছে। তবে আয় কমেছে এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর উপর সরকারকে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ৭৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৩। যাদের হিসাবে জমা ছিল ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মার্চ আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৮৫ লাখ ৫২ হাজার। তাদের হিসাবে জমা ছিল ১৩ লাখ ৮৪ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা।
এদিকে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক সাম্প্রতিক জরিপে এসব তথ্য জানা গেছে।
জরিপে আরও বলা হয়েছে, মহামারি শুরু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব অনেক বেশি।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, অতি ধনীদের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩৭ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা লকডাউনের আগে ছিল ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। এই কোভিড-১৯-এর লকডাউন আয় বৈষম্যও বাড়িয়েছে। যা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অর্থসূচককে বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও নতুন বিনিয়োগ খুব বেশি হচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগকারীদের এসব অর্থ ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা হচ্ছে। এছাড়া, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেওয়া ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখা হতে পারে। এতে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে, দেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও দরিদ্র সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। ফলে আয় বৈষম্য বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, এবারের বাজেটেও বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মূলত দেশে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণেই আয় বৈষম্য বাড়ছে। এজন্য সরকারকে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকে আরো বেশি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। আর তা না হলে দেশে আয়-বৈষম্য তীব্র আকার ধারণ করতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চের তথ্য অনুযায়ী, এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮১ হাজার ৩৪৪টি। যাদের হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি থেকে ১০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১১ হাজার ৪৮৭টি হিসাব। তাদের অ্যাকাউন্টে টাকার পরিমাণ ৮১ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা।
এছাড়া ১০ কোটি ১ টাকা থেকে ১৫ কোটির টাকার হিসাব রয়েছে ৩ হাজার ৮৬৫টি, ১৫ কোটি ১ টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১ হাজার ৭৭১টি, ২০ কোটি ১ টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ১৫৫ জন, ২৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৮৮৬ জনের, ৩০ কোটি ১ টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪৫৮ জন এবং ৩৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে ২৯০ জন আমানতকারী হিসাব রয়েছে। ৪০ কোটি ১ টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৬৪৪টি। আলোচিত সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৬৯৭টিতে দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব, বিষয়টি এমন নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটিপতি হিসাব দাঁড়ায় ১ লাখ ১৯৭৬ টি।